বাজারদর, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর এবং অপসাংবাদিকতা
আরশাদ মাহমুদ
গত কয়েক মাস ধরে নৃত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। যা এই রোজার মাসে সাধারণ এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনে এক দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। যথারীতি সংবাদ মাধ্যমগুলো এ নিয়ে খবর দিচ্ছে এবং খবরের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, ব্যবসায়ীদের কারসাজি এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ নিয়ে কি কাজ করছে সেটা বলা। দুদিন আগে এক টিভির খবরে দেখলাম, কারওয়ান বাজারে ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা অভিযানের নামে কয়েকজন দোকানিকে সতর্ক করছে। প্রথম আলোর রিপোর্টেও একই ধরনের সংবাদ পেলাম। যেমন ভোক্তা অধিকারের এক কর্মকর্তা বললেন, সাধারণ মানুষের যেন ভোগান্তি না হয় এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্ট না দেয়, সেটা আমরা নিশ্চিত করার জন্য এই অভিযান চালাচ্ছি। একইসঙ্গে ওই কর্মকর্তাকে বলতে শুনলাম, কেউ যদি বাড়তি দামে কোনো জিনিস বিক্রি করে, তবে আইন মোতাবেক তার বিরুদ্ধে বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খুবই ভালো কথা এবং আমরা এ ধরনের খবর বা অভিযানের কথা গত প্রায় ২০ বছর থেকেই শুনে আসছি। আমার প্রশ্ন একজন সাংবাদিকও কেন ভোক্তা অধিকারের কাছে এই প্রশ্ন রাখলেন না যে এ পর্যন্ত আপনারা কতজন অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং ব্যবস্থাটা কী ধরনের যেমন জেল, জরিমানা বা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি। সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোনো রিপোর্ট কোথাও দেখলাম না বা আজ পর্যন্ত শুনিনি। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধিকর্তা টিপু মুন্সি প্রায়ই একটাই কথা বলেন যে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে করে কেউ কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি না করে। এরপর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নানাবিধ ব্যবস্থা সত্তে¡ও দাম বাড়ছে কী করে তখন তিনি একটা গৎবাধা উত্তর দেন এবং সেটি হলো সিন্ডিকেট করে এই ব্যবসায়ীরা এই ধরনের কাজ করেন। আমার প্রশ্ন একটাই এই সিন্ডিকেট যারা করেন তারা কি অন্য উপগ্রহ থেকে এসে করেন, নাকি তারা বাংলাদেশেই থাকেন। আমরা সবাই জানি তারা বাংলাদেশেই থাকেন এবং মোটামুটি সবাই তাদের চেনে। তবে সরকার তাদেরকে চিনতে পারে না কেন।
উত্তরটা খুবই সহজ। এই সিন্ডিকেটের কর্ণধাররা মূলত প্রতিটা সরকারের আমলেই এই ধরনের কাজ করে থাকেন এবং কোনো সরকারই তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলকমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এর প্রধান কারণ এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সবাই শাসক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এ প্রশ্নটা খুব বেশি করে বর্তমানে আলোচিত হচ্ছে। কারণ আওয়ামী লীগ ১৪ বছর ক্ষমতায় আছে এবং একথা সর্বজনবিদিত যে এ সরকারের আমলে সিন্ডিকেটের কর্ণধারদের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর দহরম মহরম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। তবে এটা মোটেই কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। কারণ যে দেশে ঋণ খেলাপির জনক এবং শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারির নায়ক সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি হন সেখানে তো এটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো কোনো সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল এটা নিয়ে কোনো বিস্তারিত অনুসন্ধানী রিপোর্ট করছে না। আপনারা হয়তো দেখেছেন যে গত কয়েকদিন যাবত ব্রয়লার মুরগির অসম্ভব দাম বাড়ার কথা সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হচ্ছে এবং তারা বলছে যে চারটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এটা নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই চার প্রতিষ্ঠানের নাম কেউ উল্লেখ করছেন না।
আমার প্রশ্ন হলো যে তারা কি ভাসুর যে এদের নাম নেওয়া যাবে না। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠে এর পেছনে কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলো পত্রিকায় মতামত বিভাগে কল্লোল মোস্তফার একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে তার মতামত কলামটিতেও এই চার প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়নি। সম্পাদক সাহেব কি এডিট করে নামগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছেন? দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে সাংবাদিকতা বা সাংবাদিকদের নিয়ে এখন নানা ধরনের গল্প বা প্রশ্ন মানুষের মনে জাগে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সাংবাদিকরা আজ এই বড় বড় দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত সাংবাদিকতার নামে অপসংবাদিকতা যেভাবে প্রসারিত হচ্ছে তাতে করে এই ধারণা তো বদ্ধমূল হওয়াই স্বাভাবিক। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক