ফ্রান্সে আন্দোলন, রাজনৈতিক রেনেসাঁ এবং অর্থনীতি উন্নয়নের চাপ-তাপ
কাকন রেজা
আন্দোলন বিষয়ে কথা উঠলেই নানা জনে নানান কথা বলেন। তার মধ্যে প্রকাশিত ও প্রচারিত কথামালা বেশির ভাগই নেতিবাচক। অথচ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন এসব না হলে রাষ্ট্রটি যে গণতান্ত্রিক তা বোঝার উপায় থাকে না। যেমন নেই উত্তর কোরিয়া নিয়ে বোঝার উপায়। সেখানে মানুষ টু শব্দটি করতে পারে না। কিমের বাহিনীর নজর এড়িয়ে করার উপায় নেই। কেউ যদি নিতান্তই সাহস দেখিয়ে করে ফেলেন, তিনি হাপিশ হয়ে যান। যার ফলেই উত্তর কোরিয়া অপশাসনের উদাহরণ হয়ে টিকে আছে বর্তমান সময়ে।
সা¤প্রতিক বিষয়ে আসি। উত্তর কোরিয়ার কথা আর কতো বলি। ফ্রান্সের বর্তমান আন্দোলন নিয়ে আলাপ করি। অবসরের বয়স ৬২ থেকে ৬৪ করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়ের ম্যাক্রন, তাতেই সারাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। যে সে বিক্ষোভ নয়, রীতিমতো সহিংস আন্দোলন। যার ফলে বৃটেনের রাজা চার্লসের ফ্রান্স সফর বাতিল হয়েছে। রাজা হিসেবে এটাই ছিলো চার্লসের প্রথম বিদেশ সফর। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোন খোদ এই সফর বাতিলের অনুরোধ জানিয়েছেন আন্দোলন পরিস্থিতির কারণে। উত্তর কোরিয়া বা তার অনুগামী কোনো দেশের প্রধান হলে কী করতেন, করতেন ঠিক উল্টোটা। তিনি দেখাবার চেষ্টা করতেন এসব ‘আন্দোলন-টান্দোলন’ কিছু না, কচু পাতার পানি। একটু নাড়া দিলেই খেল খতম। অথবা একটু ডলা দিলেই। অথচ ম্যাক্রন তা তো করলেনই না, বরং মানা করে দিলেন বৃটেনের রাজাকে। গণতন্ত্র একেই বলে।
এখন নিশ্চয়ই অনেকে ফরাসি দেশের সমালোচনায় বসে যাবেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় উন্মুখ অনেকে। তাদের গণতন্ত্র শেখানোর স্কুল খুলে ফেলেন আর কী। ফ্রান্স বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ। অর্থনীতিও যথেষ্ট শক্তিশালী। সবদিকেই এগিয়ে রয়েছে দেশটি। ১৩৬টি দেশের মধ্যে সুখী দেশের তালিকায় ফ্রান্সের এবারের ক্রম ২১। গতবার ছিলো ২০-এ। একধাপ পিছিয়েছে। সাথে আমরা এক বছরে পিছিয়েছি ২৪ ধাপ। আমাদের বর্তমান অবস্থান ১১৮-তে। গুনে দেখতে পারেন পেছনে আর কয়টি দেশ রয়েছে। সমালোচনা করতে হয় নিজের অবস্থান দেখে। যেমন অনেকে মুসলিম দেশগুলো নিয়ে কথা বলেন, তাদের জানা উচিত এবারের সুখী দেশের তালিকায় আরব আমিরাত ২৬ এবং সৌদি আরব ৩০ এ। বাহরাইন রয়েছে ৪২ নম্বরে। আর জাপানের নম্বর ৪৭, থাইল্যান্ড ৬০। অথচ হওয়ার কথা উল্টোটা। কারণ এটা করেছে জাতিসংঘ সংশ্লিষ্টরা, ওআইসি নয়।
অনেকের ধারণা আন্দোলন বিক্ষোভ মানেই দেশের ভাব-মর্যাদা বিনষ্ট। রাজনীতিবিদদের কথা থাক, তারা বলেন রাজনৈতিক কারণে কিংবা সুবিধায়। সুবিধা শব্দটা যোগ করতে হলো। কারণ রাজনীতির সাথে হালে সুবিধা শব্দটি ভারতীয় আঁঠা ফেভিকলে যুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মুশকিল হলো কিছু মানুষ যারা এমন কথা বলেন, যাদের আমরা জানি ‘পÐিত’জন হিসেবে। যাদের বুদ্ধিজীবী বলে সম্বোধন করা হয়। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তখনই ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করে যখন বুদ্ধিজীবীরা ডগমাটিক হয়ে ওঠেন। তারা প্রতিবাদ, বিক্ষোভকে ‘মিউটিনি’ ভাবতে শুরু করেন। ফ্রান্সের আন্দোলন তাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। তারা ফ্রান্সের রেনেসাঁ নিয়ে আলাপ করবেন, কথা বলবেন, পাÐিত্য জাহির করবেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিবাদ নিয়ে কথা বলবেন না, তা তো হয় না। মিষ্টির এক দিক তেতো হয় না। আইয়ুব খান বলতেন, কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়নের কথা। আইয়ুবিয় আইডিয়া কোনকালে কোনো দেশেই দাঁড়ায়নি। আর তা কোনক্রমে দাঁড়িয়ে গেলে ব্যতিক্রম বাদে সে দেশই বসে গেছে। কোরিয়া থেকে মিয়ানমার সবারই যাত্রাপথ একই, নরকের রাস্তায়।
শেষ করি সর্বশেষ দিয়ে ইসরাইলের বিক্ষোভ দিয়ে। বিচার বিভাগে কিছু সংস্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। কিন্তু সব রেকর্ড ভেঙে তার বিরুদ্ধে পথে নেমে এসেছে মানুষ। বাধ্য হয়েছেন নেতানিয়াহু তার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে। সুতরাং রাষ্ট্র নাগরিকের জন্য। রাষ্ট্রের জন্য নাগরিক নয়। রাষ্ট্র তৈরি করে নাগরিক, মানুষ। মানুষই রাষ্ট্রের জন্য শেষ কথা। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট