ইট থেকে বাঁশ ও স্থাপত্য নির্মাণে নান্দনিকতায় বিপুলভাবে প্রশংসিত বাংলাদেশি স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম
স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম, বাংলাদেশের একজ কৃতি স্থপতি হিসেবে তার গুণের স্বাক্ষর রেখেছেন নানা নির্মাণ শৈলী স্থাপনার মধ্যদিয়ে। প্রশংসিত হয়েছেন তার অনন্য ব্যতিক্রম নির্মাণ শৈলির জন্য। তার ভাবনাও বেশ আলাদা, অন্যদের চেয়ে। তার রয়েছে ভিন্ন নির্মাণ স্থাপনা তৈরির কলা-কৌশল। এরই মধ্যে ফাইনান্সিয়াল টাইমস ও সিএনএন মেরিনার শিল্পকর্ম নিয়ে প্রকাশ করেছে প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকার।
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার এলাকায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আবাসস্থলে নকশার কাজ তিনি করেছেন। তাদের ঘর, খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্র, নারী আশ্রয় কেন্দ্র সবকিছুতেই রয়েছে তার নিপুণ হাতের স্বাক্ষর। মেরিনা স্থপতি হিসেবে রাজধানীর বায়তুর রউফ মসজিদটি নিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। তার চমকপ্রদ ডিজাইন সবাইকে করছে আলোড়িত। শুধু ইটের তৈরি কাঠামো দিয়ে এই স্থাপনাটির মূল আকর্ষণ হলো আলোর সঙ্গে খেলার এক মিশ্রন। যেখানে কৃত্রিম আলো ছাড়াই সূর্যালোক দিয়ে আলোকিত থাকে মসজিদটি। তার এই নির্মাণটিকে কিছুটা যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি লুই কানের বাংলাদেশ সংসদ ভবনের নির্মাণ শৈলির সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেকেই। তবে তাবাসসুম কিন্তু ইটের চেয়ে বাঁশকেই নির্মাণ সামগ্রীর অন্যতম কাঁচামাল হিসেবে বেশি ভালোবাসেন। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, সহজলভ্য ও যেকোনো পরস্থিতিতে এটি খাপ খাইয়ে নিতে পারে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বাঁশ দিয়ে এমন স্থাপনাও তিনি তৈরি করেছেন।
মেরিনা তাবাসসুম বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করলেও জানিয়েছেন তার অভিবাসী জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। তার পরিবার ভারতের মধ্যপ্রদেশ থেকে এ দেশে আসে। দেশ ভাগের সময় সপরিবারে পূর্ব পাকিস্তানে বাস শুরু করেন তারা। এ সময় স্মৃতি বিজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সেসময় ঢাকার পরিবেশ ছিলো চমৎকার। ছোট শহর, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সবার রয়েছে জানাশোনা। সময়টা যদিও একটু কঠিন ছিল, তথাপি ভালোবাসা আর ধারণের দিক হতে সেসময়কার পরিস্থিতিতে শান্তি আর পারস্পরিক মূল্যবোধ বজায় ছিল। অথচ আজ এই শহরটিতে বাস ২০ মিলিয়ন মানুষের। নিজেকেই বড় অচেনা লাগে নতুন এই শহরে। মনে হয় আমি এই নগরের অপরিচিত বাসিন্দা!
মেরিনার বাবা চিকিৎসক। পরিবার পরিজনদের মধ্যেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। ক্যাথোলিক মিশনারি স্কুলের পাঠ চুকিয়ে স্থাপত্য শিল্পকেই বেছে নেন পড়াশুনার বিষয় বস্ত হিসেবে। নারী হিসেবে শিক্ষাজীবনে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি ফাইনান্সিয়াল টাইমসকে জানান, এমন অসামঞ্জস্য অনুভ‚ত হয়নি কখনো। আমদের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ শীর্ষপদগুলোতে নারীরাই রয়েছেন। আর দেশের প্রধান আয়ের ক্ষেত্র গার্মেন্টস শিল্পের মূল চালিকাশক্তিও কিন্তু নারীরাই। সত্যিকার অর্থেই আমি কখনো বৈষম্যের শিকার হইনি। বরং এটি বলতে পারি, নিজের অবস্থান তৈরিতে পেয়েছি সহযোগিতা। প্রতিক‚ল পরিবেশের শিকার হইনি। ঘরে বাইরে সমানতালে কাজ করে থাকেন নারীরা আর তাই তাদের কাছে প্রত্যাশাও বেশি।
বায়তুর রউফ মসজিদটির নান্দনিকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি মূলত শুধু পবিত্র স্থান হিসেবে নামাজের জন্য নির্মিত একটি মসজিদ মাত্র। আমি ইসলামিক স্থাপত্য হিসেবে এটিকে ভাবছি না। মসজিদটির নির্মাণকালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেরিনা তাবাসসুম বলেন, সময়টা ছিল বেশ কঠিন। নাইন ইলেভেনের (৯/১১ ) পরে এমনিতেই যুদ্ধ ও ইসলামের এক মুখোমুখি সংঘর্ষ চলছিল বিশ্বজুড়ে। প্রশ্ন উঠেছিল বায়তুর রউফ মসজিদটি কি ইসলামের আরেকটি পরিচয় বহনে স্বাক্ষর রাখতে চলেছে? নানা জটিলতা আর সংশয়ের মধ্য দিয়ে আমি মসজিদটির নির্মাণ নকশা শুরু করি ২০০৫-০৬ সালে। মেরিনা বলেন, ইসলামের প্রথম মসজিদটি তৈরি করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ ( সা.)। আর সেটি নির্মাণের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল খেজুর পাতার মতো সহজলভ্য উপাদান। মূলত মসজিদটি ছিল বিচারিক ও ক‚টনীতিক কর্মস্থল ছাড়াও সামাজিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র। পরে ইসলামের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় দপ্তরও এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে উঠেছিল। এ থেকেও কিছুটা অনুপ্রাণিত হয়েছেন তিনি বলেও উল্লেখ করেন এই স্থপতি।
মেরিনা বলেন, সবাই একটি স্থাপনার অভ্যন্তরের চেয়ে বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আপনি যদি মুসলিম না হয়ে থাকেন তবে বাইরে থেকেই একটি মসজিদকে দেখে থাকবেন নির্মাণশৈলিতার জন্য। কিন্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয় কিছু না থাকলে আপনি কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করবেন না। তাই আমি বাইরের সঙ্গে একটি স্থাপনার অভ্যন্তরের বিষয়কেও সমান হারে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। ‘আমি যেকোনো স্থাপনা তৈরিতে এমন কিছু রাখি, যেখানে প্রতীকী রাখার চাইতে মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
বায়তুর রউফ মসজিদটির বিশষত্ব হলো, কলামের ভেতর দিয়ে আলো প্রবেশ করে থাকে ক্রমাগত গতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। তবে এটি তৈরিতে সহজলভ্য ও সস্তা সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সেগুলো দৃঢ় ও মজবুত। এটি ছাড়াও স্বাধীনতা স্তম্ভ ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ও স্টুডিও বিপরীত তার উল্লেখযোগ্য নির্মাণ স্থাপত্য। এগুলোর নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা খুব সস্তা ও সহজলভ্য সামগ্রী ব্যবহার করেছি। যেমন ধাতব পাত, বাঁশ যেগুলো খুব সহজেই বহন করা যায় এমন সব সামগ্রী। আমাদের দেশে বন্যায় প্রায়ই বাড়িঘর ভেসে যায়। তাই আমরা এমন স্থাপনায় বিশ্বাসী যেগুলো সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তাই বন্যা কবলিত দেশে সব কিছুকে মাথায় রেখে স্থাপত্য নির্মাণ করা উচিত। এককথায় বলতে অস্থায়ী নির্মাণ স্থাপত্যগুলোর নিজস্ব একটি স্টাইল থাকে।
সুন্দরকে ফুটিয়ে এর নান্দনিকতাকে প্রস্ফুটিত করতে কীভাবে কাজ করতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ রয়েছে। আমার জীবনের ভাবনার সঙ্গে সময়, অস্থায়ী আর স্থায়িত্বের একটি সমীকরণ একে থাকি যেটি আমার ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের মেল বন্ধন ঘটাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের আমাদের দেশের আবহাওয়া ক্রমাগত বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। তাই মজবুত ও স্থায়িত্বের দিক বিবেচনা করে আমার নকশায় অস্থায়ী নির্মাণ স্থাপনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি’ বলে অভিমত জানান স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম।
সম্পাদনা: রাশিদ। সূত্র: ফাইনান্সিয়াল টাইমস ও সিএনএন