সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা অনাস্থা এবং অর্থনীতির হালচাল
ড. আসিফ নজরুল
অনেকগুলো সংকটের মাঝে আমার কাছে মনে হয়, সরকারের প্রতি সকলের বিশ্বাস যোগ্যতার সংকটই তীব্র। এই সরকারের কোনো কথা মানুষ বিশ্বাস করছে না বা নির্ভর করতে পারছে না। ধরুন ওমুক ভাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে তার প্রতি যখন স্টাফদের বিশ^াসযোগ্যতা থাকবে, তখন তারা ধৈর্য্য হারা হবেন না, অন্য কোথাও যাবেন না, অবৈধভাবে কেউ টাকা উপার্জনের চেষ্টা করবেন না। কারণ ওমুক ভাইয়ের উপর তাদের কনফিডেন্স থাকবে। কিন্তু এই সরকারের প্রতি কোনো মানুষের ভরসা-বিশ্বাস আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে এবং এটির জন্য সরকার নিজেই দায়ী।
এই যে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার দিলো, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংককে কেউ তো বিশ্বাস করে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ডেপুটি গভর্নর ছিলেন, এর মধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধেই টাকা লুট করার অভিযোগ রয়েছে। এতো পাওয়ারফুল লেভেলে থেকেও তারা টাকা লুট করতে পারলে কীভাবে জনগণ বিশ্বাস রাখবে? পৃথিবির কোনো কেন্দ্রিয় ব্যাংকের ভল্ট হতে টাকা পাচার হবার ইতিহাস নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা লুট হলো এবং সেই তদন্ত প্রতিবেদন আজ পর্যন্ত তারা প্রকাশ করতে পারেনি। তার মানে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই কোনো বিশ্বাসযোগ্যাতা নেই। আমাদের আবহাওয়াবিদরা যখন বলেন বৃষ্টি হতে পারে, তখন আমরা ধরেই নিয়ে থাকি আজ তাহলে বৃষ্টি হবে না, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিও আস্থা হারিয়েছে প্রত্যেকে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে ব্যাংক হতে টাকা তুলে ফেলতে হবে।
তবে আমার মনের চিন্তা ভাবনাতে মানুষের কিচ্ছু যায় আসে না। আমার মতো মানুষের ভাবনাতে মানুষের মনোজগত নির্ণিত হচ্ছে না। মনোজগৎ নির্ণিত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতীত ভ‚মিকা থেকে, যেভাবে নিজস্ব ফান্ড ম্যানেজমেন্টে ব্যর্থতা দেখিয়েছে, যেভাবে ডেপুটি গভর্নরদের উপর টাকা লুটের অভিযোগ এসেছে। এগুলোর পরে মানুষ আর বিশ্বাস করবে না, এটাই স্বাভাবিক। এরপর আমাদের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে গেলে, তিনি কিছুদিন আগে দুইটি তথ্য দিয়েছেন যা ভুল। [১] বাংলাদেশে কোভিডের জন্য বিনামূল্যে টিকা দিয়েছেন, যা নাকি উন্নত বিশ্বেও দেওয়া হয়নি। তবে আমরা মিডিয়ায় দেখেছি বা স্বজনদের থেকে শুনেছি ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স এসব দেশে বিনামূলে কোভিডের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তার মানে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য ভুল। এটি জানার পর তার উপর থেকে ভরসা কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
[২] আরেকটি কথা উনি বলেছেন, রিজার্ভের টাকা দিয়ে ইনভেস্ট করা হয়েছে, লোন দেওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ বিমান করার জন্য খরচ করা হয়েছে। এই তিনটি খাতেই লস হয়ে থাকে। কিছুদিন পরপরই শোনা যায়, লোকসানের বোঝা টানতে পারছে না বাংলাদেশ বিমান। প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের লোক অর্থনীতিবিদ মঈনুল ইসলাম কিছুদিন আগে লিখেছেন, ‘এই যে বলা হচ্ছে এই সরকারের আমলে দেড় লক্ষ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে, এটি সঠিক নয়, আসলে চার লক্ষ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে এবং এই টাকা বাংলাদেশে ফেরত আসবে না’। তিনি তিনটি বিষয়ে সরকারের চরম সমালোচনা করেছেন। ঋণ খেলাপি, অর্থপাচার এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ।
সরকার রিজার্ভের টাকা দিয়ে বিনিয়োগ করেছে এবং ঋণ দিয়েছেন, যা একদমই অযৌক্তিক। কারণ যখন অত্যাধিক পরিমাণে রিজার্ভ থাকে তখনই এমনটা করা যায়। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে চরম ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এমনকি সামনে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। এমন ক্রাইসিস মোমেন্টে দেশের রিজার্ভের টাকা ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ব্যায় করার অধিকার কারও নেই, তারপরও এটি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এসকল বক্তব্য শুনে উনার প্রতি আমার নিজস্ব কনফিডেন্স আসেনি।
আমরা যারা দেশকে ভালোবাসি, তারা কোনোভাবেই চাই না দেশের মানুষের হাহাকার হোক, দেশের মানুষ সমস্যায় পড়–ক। আমি মনে করি এই সরকারের সবচেয়ে বড় সংকট হলো, আস্থাহীনতার সংকট। আমি এই সরকারের কোনো ডাটাই বিশ্বাস করি না, তারা অত্যন্ত একটি বিতর্কিত নির্বাচন পার করে এসেছে। আমরা এতোদিন শুনেছি, আমাদের রিজার্ভ নাকি ৩২ বিলিয়ন ডলার, আইএমএফ এর সঙ্গে বসার পরপরই ২৬ বিলিয়ন হয়েছে। এখন যে এই ২৬ বিলিয়নের কথা বলেছে, এটিরও প্রমাণ কী? তার মানে সরকারের কোনো তথ্যের উপরও ভরসা হারিয়েছে সকলে। কেউ যখন কোনো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে থাকে তখন উচিত নিজে থেকে সরে দাঁড়ানো। এই সরকার প্রবল বিতর্কের মধ্যে ক্ষমতায় আছে, এরা প্রকৃতভাবে নির্বাচিত কি না তা নিয়ে বহু মানুষের সন্দেহ আছে। এমন অবস্থায় তাদের উচিত ছিলো মানুষের মন জয় করার জন্য কাজ করার। উল্টে তারা বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির জঘন্য অবস্থা করে চলেছে। সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু নেই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই, সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলো কাজ করে না, সিভিল সোসাইটি কথা বলতে গেলে ডিজিটাল আইনে মামলা দেওয়া হয়। তাহলে জনগণ আস্থা রাখবে কীসের উপর?
পরিচিত : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। সূত্র : বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’ এর টকশো ‘তৃতীয়মাত্রা’ থেকে অনুলিখন করা হয়েছে। অনুলিখন করেছেন : খসরুল আলম।