চায়ের জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে কুমিল্লা
শাহাজাদা এমরান, কুমিল্লা : লাল মাটির পাহাড় হিসেবে দেশময় খ্যাত কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে উড়ছে চায়ের সবুজ পাতা। ইতোমধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার কারণে জেলা হিসেবে কুমিল্লাও স্বীকৃতি পাচ্ছে দুটি পাতা একটি কুড়ির জেলা কুমিল্লা হিসেবে। কুমিল্লার লালমাইয়ে চা বাগান আছে এ কথা প্রচার হওয়ার পর প্রতিদিনই নানা বয়সের উ’সুক জনতা ভীর করছে লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠা মজুমদার চা বাগানে। উৎসুক জনতাকেও যেন হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছে লালমাই পাহাড়ের উচু-নিচুতে অবস্থার করা চা পাতার গাছ গুলো। কুমিল্লার লালমাটি চা গাছের জন্য অনুকুল হলেও এখানে বৃষ্টি কম হওয়ায় কিছুটা প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। যার কারণে গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উঠিয়ে পাইপ দিয়ে পানির চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। কুমিল্লা নগরীর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের বড় ধর্মপুর এলাকায় আঁকাবাকা মেঠো পথ পেরিয়ে পাহাড়ের উপর ও ঢালুতে গড়ে উঠেছে মজুমদার চা বাগান। এই মজুমদার চা বাগানের মালিক হচ্ছে মো. তারিকুল ইসলাম মজুমদার। ২০২১ সালে তার মৌলভীবাজারের এক চা বাগানের মালিক বন্ধুকে নিয়ে আসেন লালমাই পাহাড়ে। লালমাটি পরীক্ষা করে ও পাহাড়ের সার্বিক পরিবেশ পর্যবেক্ষন করে বন্ধু মতামত দেন এখানে চা বাগান গড়ে তোলা সম্ভব। বন্ধুর কথা শুনেই মজুমদার সাহেব নেমে পড়েছেন কাজে।
বন্ধুর মাধ্যমে তারিকুল ইসলাম মজুমদার শুরুতেই মৌলভী বাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৮নং কালির ঘাট ইউনিয়নের বিলাশ চা বাগান এলাকার রাজু- দিপালী দম্পত্তিকে নিয়ে আসেন। মোট ২০ একজন জমির মধ্যে মজুমদার সাহেব শুরুতেই ২ একর জায়গার মধ্যে প্রথমে ৬ হাজার চাড়া ও পরবর্তীতে ৬ হাজার চাড়া দিয়ে তার নিজ নামে মজুমদার চা বাগানের যাত্রা শুরু করেন।
মজুমদার চা বাগানের প্রধান তত্বাবধায়ক রাজু শিংহ জানান, পূর্ণাঙ্গ চা গাছ থেকে কুলুপ নিয়ে বা গাছের গোড়ার দিকে ডাল দিয়ে কিছুটা প্রযুক্তি ব্যবহার করে চা গাছের চারা প্রস্তুত করা হয়। প্রথমে চারাটি ৯ইঞ্চির মত পিন্ডি করা হয়। পরবর্তীতে দেড় থেকে আড়াই ফুট হলে বিক্রি করা হয়।
চায়ের অনেক গুলো জাত থাকলেও কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের মজুমদার চা বাগানে লাগানো হয়েছে বিটি টু চা গাছ। এটি খুব উন্নত মানের চা। বিটি টু চা গাছের চারা শ্রীমঙ্গল থেকে প্রতিটি ক্রয় করতে হয় ৪৫ টাকা করে। আর একই চারা কুড়িগ্রামে বিক্রয় করে ১২ থেকে ১৫ টাকা। কুড়িগ্রামের চা মানের দিক থেকে খুব একটা ভালো না বলে জানান রাজু শিং। কুমিল্লা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ পরিচালক মো. মিজানুর রহমান জানান, কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের লাল মাটি সত্যিই চা চাষের জন্য উপযোগী। অপরদিকে, চা শ্রমিক দিপালী শিং ও রাজু শিং বলেন, আমা বংশ পরস্পরায় চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে কর্মরত আছি। আমরা মাটি দেখলেই বলে দিতে পারি এটা কতটুকু ভালো বা খারাপ। লালমাই পাহাড়ের মাটি খুবই উর্বর এবং চা চাষের জন্য উপযোগী । কিন্তু চায়ের ভালো উৎপাদন পেতে হলে বৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। যেখানে প্রচুর বৃষ্টি হয় সেখানে চায়ের উৎপাদন ভালো হয়। কুমিল্লায় যে পরিমান বৃষ্টি হয় তা মোট চাষের জন্য শতকরা ১০ ভাগ মাত্র। বৃষ্টির বিকল্প হিসেবে আমরা গভীর নলক‚পের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে পাইপের সাহায়্যে চা গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছি।
উপস্থিত চা শ্রমিকরা জানান, ছোট থেকে তিন বছর পর্যন্ত চা গাছকে নিরাপদ রাখার জন্য চা গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো হয় শজনি ও কড়ই গাছ। এই দুটি গাছ চা গাছকে ছায়াসহ বিভিন্ন উপকার করে। চা গাছ যখন উৎপাদনে যায় তখন এই দুটি গাছের ঢাল ছেটে দেওয়া হয়। বিভিন্ন ছত্রাক চা গাছকে আক্রমণ করে : উলুসহ নানা ছত্রাক বিভিন্ন সময় চা গাছকে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। তাই চা শ্রমিকদের সব সময় এই ছত্রাক সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়।
কুমিল্লার লালমাই মজুমদার চা বাগানের উৎপাদিত চা আপাতত সাধারণ চা হিসেবে খাওয়ার সুযোগ নেই। এটা খেতে হবে গ্রিন টি হিসেবে। কারণ হিসেবে বাগানের প্রধান তত্বাবধায়ক বলেন, সাধারণ চা হিসেবে খাওয়ার জন্য যে পাতা প্রস্তুত করতে হয় এই মেশিন এখনো আমরা আনতে পারিনি। আমাদের বস জানিয়েছেন, খুব দ্রæতই জাপান থেকে সেই উন্নত মানের মেশিন নিয়ে আসবেন। তাই ঐ মেশিন আসার আগ পর্যন্ত লালমাই পাহাড়ের এই চা গ্রিন টি হিসেবেই খেতে হবে।
লালমাই মজুমদার চা বাগানে বর্তমানে দুইজন স্থায়ী ও ৫ জন অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছে। রাজু শিং ও দিপাতী দম্পত্তি মাসিক মজুরি হিসেবে বেতন পান। আর সাথে থাকার ব্যবস্থা ফ্রি। অপরদিকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ৫ জন মহিলা সাপ্তাহিক মজুরি হিসেবে কাজ করেন।
লালমাই মজুমদার চা বাগানের মালিক তারিকুল ইসলাম মজুমদার জানান, আমার বন্ধু জিডি সানের উৎসাহে আমি লালমাই পাহাড়ে চা বাগান করার ভরসা পাই। আমার পুরো জায়গায়ই আমি চা বাগান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যত তারাতারি সম্ভব চা পাতা প্রস্তুতের মেশিনও বাহির থেকে নিয়ে ্আসবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
কুমিল্লা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেছেন, আসলে চা বাগান কিন্তু কৃষি বিভাগের আওতায় পড়ে না। এটা চা বোর্ডের কাজ। তারপরেও মজুমদার সাহেব আমার কাছে যখন যে সহযোগিতা চেয়েছে আমি একাধিকবার বাগানে গিয়ে সেই সহযোগিতা করেছি। আরো অন্যরা যদি লালমাই পাহাড়ে চা চাষ করতে চায় তাহলে আমি কৃষি জমি ঠিক রেখে সার্বিক সহযোগিতা করব। তিনি আরো বলেন, লালমাই পাহাড় ছাড়া কুমিল্লার আর কোথায়ও চা উৎপাদনের কোন সম্ভাবনা নেই।