মানুষ যেকোন পরিবর্তনকে প্রথমে নেতিবাচক মনে করে
মৈত্রিশ ঘটক
সহকর্মীদের জন্যে নৈশ ভোজনের নিমন্ত্রণ, তার আগে পানীয় সহযোগে কাজুবাদাম খাওয়া চলছে। এতে খিদে মরে যায়, কিন্তু নিজে থেকে তাও খাওয়া থামানো মুশকিল। বাটিটা সরিয়ে রান্নাঘরে লুকিয়ে রেখে দিলেন গৃহকর্তা। অতিথিরা তাতে খুশিই হলেন। গৃহকর্তা নিজে অর্থনীতিবিদ, অতিথিরাও অনেকেই তাই। অথচ ধ্রæপদী অর্থনীতির যুক্তিতে তাঁদের কিন্তু খুশি হবার কথা নয়, কারণ যত বেশি বিকল্প ততই তো ভাল, আর এক জনের ঠেলার তো প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। গল্পের গৃহকর্তার নাম রিচার্ড থেলার। এ রকম অনেক খটকা আর ধাঁধা থেকে আচরণবাদী অর্থনীতি নামক যে ধারাটির উদ্ভব, তার অন্যতম জনক হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অর্থনীতিবিদ।
ধ্রæপদী অর্থনীতির মূল স্তম্ভ মানুষ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত যুক্তিসম্মত ভাবে নেয়, এই বিশ্বাস। এর অর্থ, নিজের ভাল বুঝতে পারার ও নিজের সাধ্য অনুযায়ী সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। চাহিদা, জোগান, আয়, ব্যয়, সঞ্চয়, পেশা নির্বাচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিমা, পেনশন সমস্ত ক্ষেত্রেই এই বিশ্লেষণী কাঠামো ব্যবহার করা হয়। এবং এই কাঠামোর অবধারিত যুক্তি হল, অন্যের ওপর প্রতিক্রিয়া (যেমন, পরিবেশ দূষণ), কিছু সমষ্টিগত পরিষেবা (যেমন আইনশৃঙ্খলা, পরিকাঠামো), এবং সামাজিক কিছু লক্ষ্য (যেমন দারিদ্র দূরীকরণ, সর্বজনীন শিক্ষা) বাদ দিলে ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে যত দূর সম্ভব হস্তক্ষেপ না করাই বাঞ্ছনীয়।
অথচ, মনস্তত্তে¡র জগতের কিছু নীতি অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে, ল্যাবরেটরি এবং বাস্তব জগতে বিজ্ঞানসম্মত মতে করা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যে প্রমাণ জমতে থাকে, তাতে এই ‘যুক্তি-নির্ভর সিদ্ধান্তর’ কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে আশির দশক থেকে। দেখা যায়, মানুষের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে অনেক অযৌক্তিক পক্ষপাত থাকে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে এ সব সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ খামখেয়ালি ভাবে নেওয়া হয়। বরং, অনেক ক্ষেত্রেই এই পক্ষপাতগুলো নির্দিষ্ট একটা রূপ নেয়, যা বিশ্লেষণ করা, এবং সেই অনুযায়ী মানুষের আচরণ সম্পর্কে পূর্বাভাস করা সম্ভব।
মনস্তত্ত¡ আর সাবেকি অর্থনীতির মিশেলেই তৈরি হয়েছে আচরণবাদী অর্থনীতির ধারা, যার পথিকৃৎ হলেন, মনস্তত্ত¡বিদ ড্যানিয়েল কানেমান আর আমোস টভেরস্কি। মনস্তত্ত¡বিদ হওয়া সত্তে¡ও ২০০২ সালে অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার পান কানেমান (যাতে টভেরস্কির ভাগিদার হওয়া অনিবার্য ছিল, কিন্তু তিনি তার ছয় বছর আগে মারা যান)। রিচার্ড থেলার এঁদেরই উত্তরসূরি। তিনি এঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত (তাঁর কিছু কিছু গবেষণা এঁদের সঙ্গে যৌথ) হলেও, বিগত কয়েক দশকে আচরণবাদী অর্থনীতিকে হালকা কৌতূহল উদ্রেককারী নতুন ঝোঁক (যেমন জীবনমুখী অর্থনীতি) থেকে মূলধারার অর্থনীতির আবশ্যক অংশ হয়ে ওঠাতে থেলারের ভ‚মিকা অবিসংবাদিত।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমার অর্থনীতির অধ্যাপনা শুরু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে, যাকে ধ্রæপদী ও রক্ষণশীল অর্থনীতির পীঠস্থান গণ্য করা হত। থেলার সবে কর্নেল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু তা অর্থনীতি বিভাগে না, বিজনেস স্কুলে। সেটা কাকতালীয় ছিল না, কারণ আচরণবাদী অর্থনীতি নিয়ে তখনও অনেকেই যথেষ্ট সংশয়বাদী। বিজ্ঞানে যেমন অণু-পরমাণু বা কোষ হল বিশ্লেষণের এক মৌলিক উপাদান, অর্থনীতির তত্তে¡র ক্ষেত্রে তা হল মানুষের যুক্তিবাদী আচরণ। স্নাতক স্তরে মাইক্রো-ইকনমিকসের যে পাঠ্যবই ছিল, তাতে ধ্রæপদী অর্থনীতির উৎপাদন, ভোগ, চাহিদা-জোগান, শ্রম, পুঁজি, বাজারে প্রতিযোগিতা এবং একচেটিয়া শক্তির প্রভাব এই ধরনের ধ্রæপদী বিষয়, যা প্রায় একশো বছর ধরে পড়ানো হচ্ছে (যদিও তাতে গণিতের প্রয়োগ আরও সা¤প্রতিক প্রবণতা, কয়েক দশক হল শুরু হয়েছে), তা বাদ দিয়ে সবে স্থান পেয়েছে গেম থিয়োরি, নিলামের তত্ত¡, বাজারে তথ্যের অপ্রতুলতা এবং অসাম্যজনিত সমস্যার বিশ্লেষণ নিয়ে গুটিকয় অধ্যায়। সোমবার থেলারের নোবেল জয়ের খবর পাবার পর সেই পাঠ্যবইয়ের আধুনিকতম (২০১০) সংস্করণ খুলে দেখি, ঢুকে পড়েছে আচরণবাদী অর্থনীতি নিয়ে এক অধ্যায়। এককালীন বিপ্লবীরা এখন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর অঙ্গ!
যে কোনও পরিবর্তনেরই প্রথম প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক। যা আছে দিব্যি তো আছে, এই ধরনের রক্ষণশীল মানসিকতা আমাদের সবার মধ্যেই বিরাজমান। যুক্তিসম্মত চয়নের তত্তে¡র ওপর অর্থনীতিবিদদের নির্ভরতার কারণ এই নয় যে তাঁরা মনে করেন, সবাই সব সময় সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে, এবং তাঁর সম্ভাব্য সব প্রতিক্রিয়া ভেবে নিয়ে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন। বিশ্লেষণী দিক থেকে দেখলে এর মূল আকর্ষণ হল, এতে মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক আচরণবিধি নিয়ে নির্দিষ্ট একটা ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, দাম বাড়লে চাহিদা কমবে এবং জোগান বাড়বে, একই জিনিসের দু’জায়গায় দুই দাম হলে, কম দামের বাজার থেকে বেশি দামের বাজারে জিনিস চলে যাবে। থেলার ও তাঁর সহ-গবেষকরা বেশ কয়েক দশক ধরে নানা ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে দেখালেন, কিছু খুব নির্দিষ্ট রূপে মানুষ যে যুক্তির পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তার সমর্থনে প্রমাণের ভার অনস্বীকার্য। পাশাপাশি তিনি এবং অন্যান্য গবেষকরা দেখালেন, অর্থনীতির মূলধারার তত্তে¡র কাঠামোকে খানিকটা অদলবদল করে নিলে, এই ধরণের আচরণকে ব্যাখ্যা করা মোটেই কঠিন নয়।
সাময়িক প্রলোভনের ফাঁদে পা দেওয়ার প্রবণতা, যা মানুষকে তার দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের পক্ষে অনুক‚ল সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে বাধাসৃষ্টি করে, তার উদাহরণ দিয়ে শুরু করেছিলাম। এই প্রবণতার প্রয়োগের ব্যাপ্তি কিন্তু বিশাল। সঞ্চয় করা, স্বাস্থ্য নিয়ে যতœশীল হওয়া, নেশা মুক্ত হওয়া, অঘটন, ব্যাধি এবং বার্ধক্যের কথা ভেবে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া, সমস্ত ক্ষেত্রেই আমাদের মধ্যে টিনটিন কমিক্সের সেই দুষ্টু স্নোয়ির সত্তা আমাদের প্রলোভন দেখায়, আর ল²ী স্নোয়ির সত্তা আমাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্যে অনুক‚ল সিদ্ধান্তের পথ নিতে পরামর্শ দেয়। থেলারের কাজ শুধু তত্ত¡ এবং প্রমাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তিনি দেখিয়েছেন কী ভাবে আমাদের আরও ভাল সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা যায়, আক্ষরিক অর্থে ঠেলা (ঘঁফমব) দেওয়া যায়। যেমন, এক জন কর্মীর আয়ের একটা অংশ আপনা থেকেই জমতে থাকবে যদি না তিনি সঞ্চয় না করবার সিদ্ধান্ত না নেন। সে ক্ষেত্রে কিছু অর্থদÐ থাকবে, এ হল আমাদের প্রলুব্ধ সত্তার হাত থেকে আমাদের বাঁচানোর এক উপায় মাত্র, ঠিক যেমন অডিসিয়ুস প্রলোভন থেকে বাঁচার জন্যে নিজেকে মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। বাজারের কোনও দায় নেই এই কাজ করার, বরং আমাদের প্রলুব্ধ সত্তাকে ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা লাভ করতে পারে। এর থেকেই এসেছে থেলারের সরকারি নীতির ক্ষেত্রে উদারপন্থী নিয়ন্ত্রণবাদের তত্ত¡, যা এখন একাধিক দেশে সরকারি নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ার এক আবশ্যক অঙ্গ।
রক্ষণশীলতা থাকলেও অর্থনীতি বিষয়টির একটি স্বাস্থ্যকর প্রবণতা তথ্যপ্রমাণের দায়বদ্ধতা ও বিশ্লেষণী কাঠামোর প্রতি আকর্ষণ। তাই আজ অর্থনীতির মূলধারার আবশ্যক অঙ্গ হয়ে উঠেছে আচরণবাদী অর্থনীতি। থেলারের নোবেল-প্রাপ্তি তারই স্বীকৃতি। একেই বলে ঠেলার নাম বাবাজি!