টোকিওতে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ হবে বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের আঞ্চলিক হাব
আমিনুল ইসলাম : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারের বাস্তবসম্মত নীতিমালা দূরদৃষ্টির কারণে বাংলাদেশ বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও রপ্তানির একটি আঞ্চলিক হাবে পরিণত হতে চলেছে। এই দেশে রয়েছে ১৭ কোটি মানুষের বড় বাজার। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই দেশে বিনিয়োগ করে জাপান ৩শ কোটি মানুষের বাজার সুবিধা পেতে পারে।
জাপানের রাজধানী টোকিওতে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলন ‘ দ্যা রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার: ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটিজ বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড জাপান’ এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী নাকাতানি শিনিছি।
বাংলাদেশে বিনিয়োগে রিটার্ন ধারাবাহিকভাবে বেশি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ছাড়াও বাংলাদেশের ব্যবসাবান্ধব রাজস্ব ও অ-আর্থিক নীতি ও প্রণোদনা, স্থিতিশীল গণতন্ত্র, বিচক্ষণ শাসন ও নেতৃত্ব বিদেশি বিনিয়োগে ভালো রিটার্নের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি যে, বাংলাদেশ বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য অটুট ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেয়। তাই আমরা, বিশেষ করে জাপানি বিনিয়োগকারীসহ বিশ্বের সকল বিনিয়োগকারীকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগগুলো দেখার জন্য স্বাগত জানাই। তবে, প্রকৃত বিনিয়োগ এখনও কম। আমরা জাপানের কাছ থেকে আরও বিনিয়োগ চাই। আমি আপনাদের সবাইকে বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলো অনুসন্ধান করতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ যেটি নিজেই একটি ক্রমবর্ধমান বাজার এবং প্রায় তিন বিলিয়ন ভোক্তার একটি বৃহৎ বাজারের কেন্দ্রস্থলে এর অবস্থান ব্যবসা স¤প্রসারণের জন্য একটি বিশাল আকর্ষণ প্রদান করে। এইচএসবিসি গ্লোবাল রিসার্চ প্রজেকশন রিপোর্ট ইঙ্গিত করে যে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিকে ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজার হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় ও জাপানি বিনিয়োগকারীদের মনে করিয়ে দেন যে, যেহেতু তারা সচেতন যে কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে, আমরা কার্যকর পদক্ষেপ এবং হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সংকট মোকাবেলা করতে পেরেছি। আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে, প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে এবং এখনও অস্থির বিশ্ব আর্থিক পরিস্থিতি এবং সরবরাহের দিকের সীমাবদ্ধতার চাপকে ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭.১% ধরে রেখেছি। ইউক্রেন যুদ্ধ সত্তে¡ও, আমরা চলতি অর্থবছরে ৬.৫% বৃদ্ধির হার অর্জন করছি।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আইসিটি, ইলেকট্রনিক্স, অবকাঠামো, চামড়া, টেক্সটাইল, আতিথেয়তা ও পর্যটন, ভারী শিল্প, রাসায়নিক ও সার এবং এসএমইর মতো বিভিন্ন খাতে সুযোগ অনেক বেড়েছে। আমাদের সরকার ব্যবসা করার সাবলীল, সহজ এবং কার্যকর উপায়গুলো সহজতর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য তাঁর সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাই-টেক এবং সফটওয়্যার পার্ক নির্মাণ করছে। আমি জাপানি বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, বাংলাদেশ আপনাদের জন্য প্রস্তত, এবং সেখানে গেলে আপনাদের দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা হবে। আপনারা ব্যবসার সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সংস্থা এবং কাঠামো সুবিধার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে বিশেষকরে সরকারি-বেসরকারি যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপের (পিপিইডি) মতো উচ্চ পর্যায়ের যৌথ প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। স¤প্রতি ১১ এপ্রিল ২০২৩-এ অনুষ্ঠিত ৫ম পিপিইডি বৈঠকের ফলাফলকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায়।
তিনি বলেন, যেহেতু, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে স্নাতক হতে চলেছে, আমরা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ স¤প্রসারণের জন্য একটি অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্ভব করার জন্য জাপানের সাথে কাজ করছি। বাংলাদেশি ও জাপানি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সহযোগিতা দেখে প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য যেসব কোম্পানি আজ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আমি তাদের সফল অংশীদারিত্ব কামনা করছি। আমরা জাপানি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিশেষকরে আড়াইহাজারে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে আরও বিনিয়োগ আশা করি।
জাপানে বসবাসরত অনাবাসী বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, তারা তাদের রেমিটেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। আমি তাদের আরো উদ্যোক্তা বিকাশ, ব্যবসায়িক উদ্যোগে এবং তাদের জাপানি বন্ধুদের সাথে যৌথ উদ্যোগে জড়িত হওয়ার জন্যও আহŸান জানাচ্ছি। বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই আপনারা সবাই আমাদের উন্নয়ন ও অর্জনের অংশীদার হোন। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করুন। আমরা নিশ্চিত যে, আপনার বিনিয়োগ আপনাকে ব্যাপক সাফল্য এনে দেবে। আমরা জাপানের কাছ থেকে আরও বিনিয়োগ চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের রূপকল্প-২০২১ ও রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী তাঁর সরকারের ধারাবাহিকতায় তারা আমার জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করে চলেছে। একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে এবং দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটালাইজেশন, খাদ্য উৎপাদন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে উদাহরণ স্থাপন করেছে। বাংলাদেশের সহনশীল জনগণ এখন আশা ও আশাবাদ নিয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি বিভাগ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি আধুনিক, উন্নত এবং জ্ঞানভিত্তিক ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর দিকে আমাদের যাত্রায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
গত বছর বাংলাদেশ জাপানের সঙ্গে ক‚টনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করেছে । তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধংসযঞ্জে পরিণত হওয়া থেকে বিস্ময়করভাবে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হওয়া জাপানের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। আমাদেরও একই রকম গল্প আছে। আমাদের জাতির পিতা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেননি কারণ, তিনি এবং তাঁর পরিবারের প্রায় অধিকাংশ সদস্যকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমি ও আমার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যাই। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমি আমার পিতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আধুনিক ও উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। আলোচনার শুরুতেই তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন, যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ১৯৭১ সালে আমাদের একটি নিজস্ব মাতৃভ‚মি বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রæয়ারি দ্রæতই জাপান আমাদের নতুন দেশকে স্বীকৃতি দেয়। তারপরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাপান সফর করেন এবং দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন।’
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) যৌথভাবে এই সম্মেলনের আয়োজন করে। এই সম্মেলনের সহ-আয়োজক জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) এবং জাপান-বাংলাদেশ কাউন্সিল কমিটি ফর কমার্শিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (জেবিসিসিইসি)। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাপান চেম্বার অব কমার্স (জেসিসিআই) এর প্রেসিডেন্ট কোবায়াশি কেন, জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহাবুদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনরি এবং জেট্রোর প্রেসিডেন্ট ইশিগুরো নরিহিকো।