গার্মেন্টস শ্রমিকদের লড়াই-সংগ্রাম
মোশরেফা মিশু
১৯৯৫ সাল থেকে আমি গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করে আসছি। এর মধ্যে ৭ বার গ্রেফতার হয়েছি। জেল-জুলুম হুলিয়া পুলিশ রিমান্ড গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে গোপনে মানবেতর জীবন যাপন করেছি, কতোবার পুলিশি হামলা ও মালিকপক্ষের হামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে, ১১ দিনের অনশনে মৃত্যুর মুখোমুখি পড়েছি, সরকার ও মালিকপক্ষের দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় হয়রানির মুখোমুখি হয়েছি, তবুও দেশের প্রধান প্রধান মিডিয়াগুলো আমাদের আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশে কোনো রকম দায়িত্বশীলতার বা বস্তনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে তাদের কোনো ভ‚মিকা লক্ষ্য করা যায় না। অথচ যারা কে নোদিন পুলিশ ও মালিক পক্ষের একটি ফুলের টোকারও মুখোমুখি হবার সৌভাগ্য লাভ করেননি তাদের সামান্য কাজকেও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মিডিয়াগুলো দিনের পর দিন প্রচার করে চলেছে। উল্লেখ না করে পারছি না যে, গার্মেন্টস শ্রমিকরা আজ সামান্য যতটুকু অধিকার ভোগ করছেন, তা আমাদের দীর্ঘ বছরের জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়নের কারণেই সম্ভব হয়েছে। ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা যা করেছি তা অন্য কেউ করেনি। অথচ সংবাদপত্রে অন্যদের কথা থাকলেও, আমাদের সংগঠনের কোনো সংবাদ নেই।
২৪ এপ্রিল ২০২৩। সকাল পৌনে আটটায় বেড়িয়ে পড়লাম বাসা থেকে কলাবাগান বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশে। সকাল সোয়া নয়টায় সাভারে রানা প্লাজার সামনে গিয়ে বাস থেকে নামলাম। ওখানে গিয়ে দেখি ছড়ানো ছিটানো কিছু সংগঠন ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের কর্মীদের সঙ্গে দেখা। তারা খুশি হয়ে আমাকে নিয়ে গেলো ভবন ধসের জায়গায়, বেদীর একটু পেছনে। গিয়ে দেখি রানা প্লাজার আহত শ্রমিকরা চার দফা দাবিতে ‘অনশন’ করছেন। তারা আমাকে হাতে ধরে তাদের সঙ্গে অনশনে বসিয়ে দিলেন। এই অনশনে আরও অংশ নিয়েছেন আমাদের সংগঠন ‘গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম’ এবং ‘রানা প্লাজা শ্রমিক ইউনিয়ন’। রানা প্লাজা শ্রমিক ইউনিয়ন আমাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। অনশন চলছে আর আহত শ্রমিকরা একেকজন তাদের দাবি উত্থাপন করে বক্তব্য রাখছেন। যে চার দাবিতে তারা অনশন করছেন, তাহলো, ক্ষতিপূরণ, খুনি সোহেল রানা ও পাঁচ কারখানার মালিকদের সর্বোচ্চ শাস্তি, আহতদের সুচিকিৎসা ও আহতদের পুনর্বাসন।
সাড়ে দশটার দিকে আমাদের সংগঠন, আহত শ্রমিকরা যারা হাঁটতে পারেন এবং রানা প্লাজা শ্রমিক ইউনিয়ন যৌথভাবে মিছিল করে শ্লোগানসহ একে একে শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করলাম। স্মৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আবার আমরা অনশনে বসলাম। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে জানিয়ে রাখতে চাই যে, এই আহত শ্রমিকরা গত ২২, ২৩, ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অনশন করেছেন। এমনকি ২২ তারিখ ঈদের দিন তারা সাভার থেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অনশন করে গেছেন। আহত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললাম পরবর্তী করনীয় নিয়ে। তারা পরিষ্কার ভাষায় আমাকে জানিয়ে দিলেন, সরকার তাদের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল ছয়টা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাবেন। কারও কথায় তারা অনশন ভাঙবেন না। কাউকে তারা বিশ্বাস করেন না। দীর্ঘ বছর শ্রমিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা সত্তে¡ও তাদের কথায় আমি খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম।
অনশনে বসে বসেই ভাবতে লাগলাম কী করা যায়। কিছুক্ষণ পর নানাজনের সঙ্গে পরামর্শ শুরু করলাম। সংগঠন, রানা প্লাজা ইউনিয়নের নেতৃত্ব সবাই এক যোগে বললো, আমাদের কথা ওরা মানবে না। আমাদের মাথায় কোন সমাধান আসছে না। এখন যা করার আপনাকেই করতে হবে। আপনাকে ওরা বিশ্বাস করে। বেলা ১টা শেষ হয়ে ২টা বেজে গেলো। সবাই চলে গেছে। আমরা অনশনে বসা। আমি এবার ডেসপারেট হয়ে অনশনরত আহত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। বোঝাতে থাকলাম, দেখুন আপনারা এমনিতেই অসুস্থ। প্রতিদিন এভাবে অনশন করলে শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়বে। তারা সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলো। হোক খারাপ। আমরা এ জীবন নিয়ে আর বাঁচতে চাই না। ওদের এই কঠিন প্রতিজ্ঞা দেখে আমিও এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। শরীর যদি খারাপ হয় তো হোক এই আহত শ্রমিকদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দৃঢ় আন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে। সংগঠন ও রানা প্লাজা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করে ঘোষণা দিলাম, আমি দায়িত্ব নিয়ে আপনাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করছি, আহত শ্রমিকদের উত্থাপিত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা জীবনবাজি রেখে আন্দোলন গড়ে তুলবো। দরকার হলে কাফনের কাপড় পড়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে পড়ে থাকবো।
আপনাদের দাবি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এক চুলও উঠবো না। এরপর বললাম, আমার প্রতি যদি আপনাদের বিশ্বাস থাকে, তাহলে আশা করি আপনারা আমার হাতে পানি খেয়ে অনশন ভাঙবেন এবং ঘরে ফিরে যাবেন। শ্রমিকরা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। আমারও দু’চোখ বুঝি ভিজে এলো। এরপর একেজনের মুখে পানি দিয়ে অনশন ভাঙালাম। তাঁরা চোখ মুছে হাসিমুখে বাড়ির পথ ধরলো। কিন্তু আমার চোখে পানিও নেই। মুখে হাসিও নেই। কী কঠিন দায়িত্ব নিলাম তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি তখন। কতো জায়গায় ধরনা দিতে হবে। কতো কঠিন পথ হাঁটতে হবে। ১০ বছরে যা সম্ভব হয়নি, তা সম্ভব করতে হবেই, হবে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে হবে সমানতালে। ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম। আপা ঢাকা যাবেন না? সংগঠনের শ্রমিক কমরেডদের ডাকে ফিরে তাকালাম। বিকেল ছুঁই ছুঁই। ওনারা বাসে তুলে দিলেন। বিকেল নাগাদ ঢাকা ফিরলাম। ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। রোদে চোখ মুখ পুড়ছে। রানা প্লাজার হতাহত শ্রমিকদের মনে মনে লাল সালাম জানিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
লেখক: সভাপতি, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম