অর্থনীতির বিনিময় প্রথা, আইএমএফ, শক্তিমান ও দুর্বলের অসামঞ্জস্য
কাকন রেজা
বিনিময় প্রথা কেন ক্লিক করতে পারেনি তা বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেগুলো কারণ বলতে হয়। তবে অন্যতম কারণ হলো অভাবের অসামঞ্জস্যতা। একজন ধনীর কাছে খাদ্য সামগ্রী রয়েছে, একজন গরিবের কাছে রয়েছে একটি চেয়ার। কিন্তু তার ঘরে খাবার নেই। সুতরাং সে বিনিময় করতে চাইলে ধনীর চাপিয়ে দেওয়া পরিমাণই মেনে নিতে হবে। একটা চেয়ার দিয়ে এক মন চাল পাওয়া গেলেও, ধনীর দেওয়া পাঁচ কেজি মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কারণ ক্ষুধার বিপরীতে পছন্দের কোনো অপশন নেই। গরিবদের অবশ্য এই মুদ্রা প্রথার যুগেও আলাদা কোনো অপশন নেই। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে। এখানেও বিনিময় প্রথা চালু রয়েছে। ঋণের কথা বলে যেমন আইএমএফ আমাদের আদ্যোপান্ত জানতে চাইছে। আমাদের জানাতে হচ্ছে উপায় নেই। ধন আর শক্তির কাছে বিনিময় প্রথায় ঋণপ্রার্থী দরিদ্রদের মেনে নেওয়া ছাড়া তেমন কোনো উপায় হাতে থাকে না।
আমাদের ট্রানজিট ব্যবস্থার কথাই ধরুন। ট্রানজিটের বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি? বিনিময়ে সমতার কি কিছু রয়েছে? নেই। ইউক্রেনের কথা বলি। রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পশ্চিমাদের কাছে হাত পাততে হয়েছে। পশ্চিমারা রাশিয়াকে সাইজ করার প্রকল্প নিয়েছে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে। তারা হয়তো সফল হবে, ইতোমধ্যে রাশিয়ার অর্থনীতির কাঁটা প্রায় বারোটার ঘরে। ভারত, ইরান এবং চীন মিলে নিভু-নিভু অর্থনীতির প্রদীপে ডলার জোগাচ্ছে। এখানেও সেই বিনিময় প্রথা। উপায়হীন রাশিয়া তাদের কাছে কম মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রি করছে। আর ইউক্রেনে বিনিময় প্রথায় বাড়ছে লাশের সংখ্যা। অভাবের অসামঞ্জস্যতাই মূলত এর জন্য দায়ী। বিনিময় প্রথার অন্তরায়ও তাই। এই অভাবের অসামঞ্জস্যতার আড়ালে সৃষ্টি হয় একটা তৃতীয় পক্ষ। বিনিময় প্রথার কালেও তৃতীয় পক্ষ ছিলো। ইংরেজিতে যাদের বলা হয় ব্রোকার, বাংলায় দালাল কিংবা ফড়িয়া। তারা দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে নিজেদের লাভটা রেখে দেয়। মধ্যস্বত্বভোগী তার আপাত ভদ্র নাম। এই ডিজিটাল যুগেও এমন ফড়িয়ার দেখা অনেক পাবেন। দ্রব্যমূল্যের হ্রাসবৃদ্ধির মূলে রয়েছে অনেকটাই এদের কারসাজি। তবে খারাপের সঙ্গে এর ভালো দিকও রয়েছে বর্তমান মুদ্রা ব্যবস্থায়। বিনিময় প্রথায় যা ছিলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক তা এখন প্রাতিষ্ঠানিক।
একটা সা¤প্রতিক উদাহরণ দিই। ফেসবুক বাংলাদেশ থেকে তাদের বিজ্ঞাপনী কার্যক্রম সীমিত করার কথা ঘোষণা দিয়েছে। ফেসবুককে কেন্দ্র করে মধ্যস্বত্বভোগীদের একটি প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছিলো ‘এফ কমার্স’ নামে। কর্মসংস্থানের একটা জায়গা সৃষ্টি হয়েছিলো, যা মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু সেটাও এখন যায় যায়। কিন্তু এই যাওয়ার আশঙ্কার মূলে কিন্তু ওই বিনিময় প্রথা। যেটা হয় রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, ক‚টনৈতিক বিনিময়। ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা কী বলছে তাদের বিজ্ঞাপনী কার্যক্রম সীমিত করার জন্য, তারা বলছে ডলার সংকটের কথা। বাংলাদেশ থেকে অর্থ স্থানান্তরের সমস্যার আলাপ তুলছে। অর্থাৎ তারা যা আয় করছে, তা ডলারে রূপান্তর সম্ভব হচ্ছে না। অস্বীকার যতই করা হোক না কেন, ডলার সংকট থেকে এখনো বের হয়ে আসা সম্ভব হয়নি। হওয়াটা এতো সহজ নয়। ওই যে, আগেই বলেছি অভাবের অসামঞ্জস্যতা। গরিবের দেওয়ার মতন অনেক কিছু থাকে না, যা দিয়ে সবাইকে খুশি রাখা যায়। সুতরাং অল্পে তুষ্ট দেবতা খুঁজতে হয় তাদের। এই খুঁজতে গিয়ে শুরু হয় আরেক দেবতার সঙ্গে দ্ব›দ্ব। যার শেষ হয় শক্তির প্রাবল্যে কেড়ে নেওয়ার মধ্যে।
অভাবের অসামঞ্জস্যতা সমন্বয় করার অতীত উপায় ছিলো লোকবল। গরিব লোকের যদি লোকবল থাকতো, আধুনিক কালে যাকে বলা হয় জনসমর্থন। ধনীলোক তখন নিজের মূল্যমান চাপিয়ে দিতে পারতো না, কারণ প্রতিরোধের সম্ভাবনা থাকতো। হাল আমলেও তা। শ্রীলঙ্কার রাজা পাকশেদের যদি জনসমর্থন থাকতো, তাহলে তারা দুই ধনীর দ্ব›েদ্ব জড়াতো না। তারা বিনিময় করেছিলো আনুগত্য ক্ষমতার বিপরীতে এবং তা ধনী অর্থাৎ শক্তিমানের কাছে। আর সেই শক্তিমান হলো চীন। বিপরীত শক্তি যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গতই বিক্ষুব্ধ হলো। তারপরের ঘটনা তো চোখের সমুখে এবং এখনো চলমান। সুতরাং ক‚টনৈতিক বিনিময় প্রথায় শক্তিমানদের বিরুদ্ধে দুর্বলের শক্তি হলো লোকবল, অর্থাৎ জনসমর্থন। আর তা না থাকলে বিনিময় প্রথা হয়ে যায় শক্তিমানের ইচ্ছা নির্ভর। বুকের উপর পা দিয়ে চলে গেলেও বলার কিছু থাকে না।
ফুটনোট: অর্থনীতির সিরিয়াস টাইপ বিশ্লেষণ ভাবার কোনো কারণ নেই এই লেখাকে। কেউ কেউ রম্যও ভাবতে পারেন। এমনটা মূলত একটা ধারণা থেকে বলা। যে ধারণা গত দেড় দশক ধরে গড়ে উঠেছে। বলতে পারেন তিলে তিলে গড়ে তোলা হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট