কোরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলামি অর্থনীতির মৌলিক দর্শন
জিল্লুর রহমান
ইসলামী অর্থনীতি শুধু বস্তুগত বিষয়ের উপরে আবর্তিত হয় না, এর বড় একটি আধ্যাত্মিক দিকও রয়েছে। ইসলামে যে জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে, তার আলোকেই অর্থনৈতিক দর্শন গড়ে উঠেছে। ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক দুটো বিষয় হচ্ছেÑএক. সম্পদের মালিকানা। দুই. সম্পদের সুষম বন্টন।
সম্পদের মালিকানা: সম্পদের আরবি প্রতিশব্দ ‘মাল’ শব্দটির ধাতুগত অর্থ বেশ পরিচ্ছন্নভাবে এ ব্যাপকতাকে নির্দেশ করে। আরবী ‘মাল’ এর ধাতুগত অর্থ আকর্ষিত হওয়া, অবনমিত হওয়া, ঝুঁকে পড়া। ধাতুমূলক এ অর্থ বিবেচনায় যেসব বিষয় মানুষের মাঝে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় কিংবা যেসব বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণবোধ তৈরি হয় তাই সম্পদ। অন্যদিকে পবিত্র কুরআনের ভাষ্য হলো, ‘ভ‚-পৃষ্ঠের যাবতীয় কিছুই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন’। -সূরা বাক্বারা:২৯।
মূলত সমগ্র বিশ্বলোকে যা কিছু আছে সব কিছুর একচ্ছত্র মালিকানা স্বত্ব একমাত্র বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর। তাঁর এ স্বত্তাধিকারে কারও কোনো অংশিদারিত্ব নেই। আল্লাহ বলছেন, মহাকাশ ও ভ‚মিতে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই। আল্লাহর নিকটই সবকিছু প্রত্যানীত হবে। -সূরা আল ইমরান-১০৯। আল্লাহ মানুষকে এ পৃথিবীর প্রতিনিধিরূপে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে মানুষ প্রতিনিধি মাত্র।
আলাহ বলেন, নভোমন্ডল ও ভ‚মন্ডলে এবং তৎমধ্যবর্তী যা কিছু আছে সবকিছুর মালিকানা স্বত্ব এবং সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। তিনিই সর্ববিষয়ে শক্তিমান। -আল মায়েদা :১২৭। আর মানুষ হলো সম্পদ ব্যবহারে তার প্রতিনিধি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আল্লাহ তোমাদের যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন তা হতে ব্যয় করও। -সূরা আল হাদিদ-৭। কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের যে সম্পদ দিয়েছেন, তা থেকে তাদের দান করও’। – সুরা নূর, আয়াত: ৩৩। এই আয়াত থেকে খুবই সুস্পষ্ট যে, আল্লাহই সম্পদ দান করেন, তিনিই সম্পদের মালিক।
অন্যদিকে আল্লাহ এটাও বলেন যে, ‘এবং তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে’ সুরা আল মা-আরিজ ২৪ ও ২৫। কোরআনে আল্লাহ ‘তাঁদের সম্পদ’ বলে উল্লেখ করে মানুষকে সম্পদের মালিকানার স্বীকৃতিও দিয়েছেন। এর কারণ আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর প্রকৃতি বা ফিতরাত সম্পর্কেও তিনি অবহিত। আল্লাহ তা’আলা যে ফিতরাতের উপর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মালিকানার বাসনা যা এমনকি অবুঝ শিশুদের মধ্যেও আমরা লক্ষ্য করি। মূলত, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এই প্রবৃত্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যাতে তা মানুষের কর্মচঞ্চলতা, উৎকর্ষতা ও দক্ষতার শক্তিশালী চালিকাশক্তি হতে পারে। কেউ যখন জানতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত সে তাঁর অর্জন ও পরিশ্রমের ফল পাবে তখন সে কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে নিয়োজিত করে, প্রাণপনে চেষ্টা করে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এতে জীবন উন্নত হয়, সভ্যতা বিকশিত হয়। মালিকানা হলো মানবতার বৈশিষ্ট্য। কেননা পশু-পাখি মালিকানা লাভ করতে পারে না, মানুষই শুধুমাত্র মালিকানা লাভ করতে পারে। তাই তো ইসলাম ব্যক্তি মালিকানার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেননা এটি এমন দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) যা এসেছে ফিতরাত, স্বাধীনতা ও মানবতাকে সম্মান জানানোর জন্য, অর্থাৎ মানুষকে সম্মান দেখানোর জন্যেই আল্লাহ বলেছেন তোমাদের সম্পদ। তবে সম্পদ যে ধরনেরই হোক না কেন তার প্রকৃত মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। শুধু ব্যক্তি নয় ইসলামে কোনো রাষ্ট্রও এককভাবে সম্পদের মালিক নয়, সেটা যদি স্বীয় ভূমি থেকে বের হওয়া খনিজ সম্পদও হয়ে থাকে। আজকের পৃথিবীতে যে ধনী গরীব বৈষম্য, তাঁর মূল কারণ সম্পদে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে স্বীকার করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠা।
ইসলামে সীমানাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বীকৃতির নেই, খেলাফত যুগে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো/তাঁদের আয় থেকে উন্নয়ন ব্যয় মিটিয়ে কেন্দ্রীয় কোষাগারে উদ্বৃত্ত/অর্থ জমা দিতে হতো, অর্থাৎ খেলাফতে কোনো ব্যাক্তি বা অঞ্চলভিত্তিক সম্পদের মালিকানা গড়ে উঠেনি, আর খেলাফত ছিলো এই সমুদয় সম্পদের পাহারাদার, ইসলামে সম্পদের মালিকানার দর্শনকে মোটামুটি এভাবেই ভাবা যেতে পারে।
সম্পদের সুষম বন্টন: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত আদম সন্তানের পা তার প্রতিপালকের সামনে নড়বে না। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং কোন পথে ব্যয় করেছে। -সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৪১৬।
ইসলামে সম্পদে সুষম বন্টন নিয়ে আলোচনার আগে, প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের তৈরি ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট বা বৈশ্বিক অসমতা প্রতিবেদনটি একটু দেখে নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৭৬ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত রয়েছে শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী মানুষের হাতে। মধ্যম আয়ের ৪০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মোট বৈশ্বিক সম্পদের ২২ শতাংশ আর নি¤œ আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মাত্র ২ শতাংশ সম্পদ। বৈশ্বিক পুঁজির ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর হাতেই সিংহভাগ পুঁজি পুঞ্জীভ‚ত হয়ে আছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সারা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ এই ধনীদের হাতেই। এই প্রসঙ্গে কোরআন বলছে, ‘সম্পদ যেন তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তন না করে’। -সুরা হাশর, আয়াত: ৭। তাদের (বিত্তবানদের) সম্পদে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের হক আছে’ -সুরা যারিয়াত-১৯। আমরা দেখলাম যে, কিভাবে সম্পদ অল্প কিছু মানুষ কুক্ষিগত করে রাখা হয়, কিন্তু ইসলাম সম্পদের মালিকানার এই বৈশিষ্ট্য মেনে নেয় না।
ধনীদের সম্পদ থেকে অর্জিত যাকাতের অর্থ আল্লাহ আটটি খাতে ব্যয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। যাকাত প্রদানের ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনীতির বুনিয়াদ সুদৃঢ় হয়। দারিদ্র্য বিমোচন, আয় বৈষম্য হ্রাস, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, উৎপাদন ও ভোগ বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে সহায়তা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বণ্টন ব্যবস্থার উন্নতি ও সম্পদ পুঞ্জীভ‚ত হওয়া রোধ করে। সেই সাথে ঋণমুক্তি, মৌলিক চাহিদা পূরণ, সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বাস্তবায়ন, সৌহার্দ্য ও ঐক্যবোধ সৃষ্টি এবং সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করে। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় যাকাত আদায় এবং গ্রহণের ফলে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। যাকাত প্রদানকারীর সম্পদ কমে না বরং বৃদ্ধি পায়, আর যাকাত গ্রহণকারীরা তাদের ন্যায্য প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এতে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে সমতা বিরাজ করে।
আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রাণপ্রিয় ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও ক্রীতদাসদের মুক্ত করার জন্য ব্যয় করবে’ -সুরা বাকারা-১৭৭। আল্লাহ আরো বলেন, ‘এ সাদকাগুলো তো আসলে ফকির-মিসকিনদের জন্য আর যারা সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত এবং যাদের মন জয় করা (দ্বীনের জন্য) প্রয়োজন, তাদের জন্য। তাছাড়া দাসমুক্ত করার, ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করার, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের উপকারে ব্যয় করার জন্য এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিধান এবং আল্লাহ সব কিছু জানেন, তিনি বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান’ -সুরা তাওবা-৬০। ধন বণ্টন এবং ব্যয়ের ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) উল্লেখ করেন, ‘হজরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা মুসলমান ধনী লোকদের ধন-মাল হতে এমন পরিমাণ দান করা ফরজ করে দিয়েছেন, যা তা দ্বারা গরীব-ফকির-মিসকিনদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হতে পারে। ফলে ফকির গরিবরা যে ক্ষুধার্ত কিংবা উলঙ্গ থেকে কষ্ট পায়, তার মূলে ধনী লোকদের সাবধান হওয়া উচিত। নিশ্চয় জেনে রাখ আল্লাহতায়ালা এই লোকদের খুব শক্তভাবে হিসেব গ্রহণ করবেন এবং তাদের দেবেন কঠিন পীড়াদায়ক আজাব। -তিবরানী, আসসাগীর ও আল আওসাত।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক গণকণ্ঠ। ই-মেইল:[email protected]