কৃষি কাজেও তাঁর ‘চেয়ারম্যানগিরি’!
ভূঁইয়া আশিক রহমান
[২] ফজলুল করিম দর্জি। ইউপি চেয়ারম্যান। কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার ১০ নং গল্লাই ইউনিয়নের দায়িত্ব পালন করছেন এখন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। রাজনীতি করছেন দীর্ঘদিন ধরে। কৃষি তার পেশা। নেশা। ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটা সময় শখের বশে বিদেশ চলে গিয়েছিলেন। সিদ্ধান্তটি ভুল ছিলোÑ যখন বুঝতে পারেন, তখন ফিরে আসেন দেশে। কৃষিতে সময় দিতে থাকেন। একানব্বই সালে ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচন হন। দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ২০২২ সালে। এখন বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করেন। গরুর খামার আছে। ধানের আবাদও করেন। একইসঙ্গে জনসেবার কাজও করেন সমানতালে।
[৩] কৃষির সঙ্গে কবে থেকে, কীভাবে যুক্ত হলেন জানতে চাইলে ফজলুল করিম দর্জি স্মরণ করেন মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩-৭৪ সালে চান্দিনা উপজেলায় ইরি ধানের বীজ তিনি ও হাকিম নামে তার এক বন্ধু শুরু করেন। ঘুরঘার বিলে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়, ভারত-বাংলাদেশের বর্ডারের কাছে বলদা নামক জায়গায় ৮-নম্বর ইরি ধান দেখে ওখান থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিজে এলকায় নিয়ে আসেন। সে স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশ) থেকে মেশিন আনতাম। তখন আমি বিএডিসির প্রজেক্টের চেয়ারম্যান ছিলাম। মেশিন এনে ইরি ধানের আবাদ শুরু করলাম। হেউত দিয়ে পানি দিতাম। পাঁচ গন্ডা (৩০ শতাংশ) জমি প্রথম করেছিলাম। সেই জমিতে ২৫ মন ধান পেয়েছিলাম। মানুষ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো, মাত্র ৫ গন্ডা জমিতে এতো ধান! এলাকার মানুষও তখন আমার দেখাদেখি ইরি ধানের আবাদ শুরু করলো। ঘুরঘার বিলে এখন ১০টি ডিপ মেশিন আছে। সেখানে অবাদে ইরি ধানের আবাদ হয়। ইরি ধানে এখন স্বয়ংসম্পন্ন ঘুরঘার বিল।
[৪] কথায় কথায় স্মরণ করেন চান্দিনার প্রয়াত বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সাবেক সংসদ সদস্য ও সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক আলী আশরাফের কথাও। কৃষিতে কীভাবে তিনি কৃষকদের সহযোগিতা করেছেন, বললেন সেটাও। ফজলুল করিম বলেন, ১৯৭৪ সালে চান্দিনা-৭ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ কয়েকজনকে নিয়ে ঘুরঘার বিল পরিদর্শন করেছিলেন হেলিকপ্টার করে। ঘুরঘার বিল ও ইরি ধানের চাষ প্রকল্প তারা সরোজমিনে দেখেছিলেন। এতে এই বিলটি নিয়ে তাদের মধ্যে একটা ইতিবাচক মনোভাব ও সুদৃষ্টি তৈরি হয়। ধীরে ধীরে ডিপ মেশিনগুলো এনে পুরো ঘুরঘার বিলে লাখ লাখ টন ধান উৎপাদন শুরু হয়। কৃষিতে বেশ ভালো করছিলাম আমি। ৭০০-১৫০০শ মন পর্যন্ত ধান উৎপাদন করতে পেরেছিলাম তখন।
[৫] কৃষিতে বেশ ভালো করলেও কেন বিদেশে গেলেনÑএমন প্রশ্নের জবাবে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন এই মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, হঠাৎ কী এক শখ পেয়ে বসলো। বিদেশ যেতে হবে। অনেকে বিদেশে যায়, আমাকেও বিদেশে না গেলে হয়! শখের বশে ১৯৮০ সালে বিদেশে চলে যাই। বিদেশ বসেও কৃষি কাজ ঠিক রেখেছিলাম। আশি থেকে একানব্বই সালÑএগারো বছর বিদেশ করি। প্রথম যাই সিঙ্গাপুর। সেখানে সাত মাস কাজ করেছিলাম। ভিসা সমস্যার কারণে দেশে ফিরতে হয়েছিলো। ইরাকেও গিয়েছিলাম। ১৯৮২ সালে। সেখান থেকে ফিরে সৌদি আরবেও ঢুকেছিলাম। সেখানে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ছিলাম।
[৬] ১৯৯১ সালে দেশে ফিরে আসার পর এলাকার জনগণ ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে চাইলেন। মানুষের বিপুল সমর্থনে ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হলেন ফজলুল করিম। হরিণ মার্কায় ভোট করলেন। মানুষ ভোট দিলো। ইউপি চেয়ারম্যান হয়ে গেলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনো এক অভিযোগে মামলা থাকায় নির্বাচন হচ্ছিলো না। ফলে আরও ৪ বছর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিলো তাকে।
চেয়ারম্যান হওয়ার পরবর্তী সময়ে কৃষি ও জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনে কি কোনো সমস্যা হয়নি বা চ্যালেঞ্জটা কী ছিলো তখন? কৃষক কাম চেয়ারম্যান ফজলুল করিম বলেন, চেয়ারম্যান হয়েছি বটে, তবে কৃষি থেকে কখনোই বিচ্যুত হইনি কখনোই। কোনো না কোনোভাবে কৃষির যুক্ত ছিলাম। সেটা বিদেশে থাকাকালেও। চেয়ারম্যান হওয়ার পর একদিকে জনসেবা, অপরদিকে নিজের আয়ের উৎস কৃষি কাজে আবারও পূর্ণ মনোযোগ দিই। ইরি ধান আবাদের পাশাপাশি মাছে চাষ শুরু করি। গরুর খামারও করলাম। ২৪টি গরু নিয়ে শুরু করেছিলাম। গাভী ছিলো। এখনকার মতো উন্নত গো খাদ্য ছিলো না। উন্নত ঘাসও ছিলো না। ঘাসের অভাব ছিলো। উন্নতমানের মার্কেটিং ব্যবস্থাও ছিলো না। দুধের মার্কেটিং করতে পারতাম না। বিভিন্ন কারণে গরুর খামারে লোকসান হচ্ছিলো দেখে গরু বিক্রি করে মুরগির খামারে শিফট করি। ২০ হাজার ডিমের মুরগি পর্যন্ত আমি পালন করেছি। মুরগির খামার বেশ ভালো চলছিলো। মুরগির খামার দিয়ে আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল হই। একটা সময় মুরগির ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। আয় ও ব্যয়ে ভারসাম্য রাখা যাচ্ছিলো না। বড় রকমের লোকসানে পড়েছিলাম। ফলে মুরগির খামার বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মুরগির খামারের সেই লোকসান কাটিয়ে কৃষিই এখন আমার দিবানিশি!
[৭] ধান চাষ করছেন। আবারও গরুর ফার্ম দিয়েছেন। মাছ চাষও করছেন। ২০ কানি জলাশয়ে মাছের প্রজেক্ট। ২০ কানি মানে ৪০০ গন্ডা। ২ হাজার ৪০০শ শতাংশ। এসব জমির মধ্যে কিছু লিজ নিয়েছেন, তবে বেশির ভাগই নিজের সম্পদ। মাছের প্রজেক্টের একটা ৮ কানি, আরেকটি ৬ কানির প্রজেক্ট। বাদবাকিগুলো ছোট ছোট জলাশয়। সেগুলোতে মাছের চারা দেওয়া হয়। বড় প্রজেক্টে মাছ চাষ। মাছের প্রজেক্ট, গরুর খামার, ধান আবাদÑ১০ জন কর্মচারী কাজ করেন। তিন মাস পর পর মাছের প্রজেক্ট তুলেন (মাছ বিক্রি করা)। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি ৬ মাসে মাছের প্রজেক্ট থেকে ৩০-৩৫ লাখ আমার আয় হয়।
কৃষি কর্মকাÐ পরিচালনা করতে গিয়ে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় আপনাকে? ফজলুল করিম দর্জি বলেন, কৃষি উপকরণের দাম বেড়েছে। তবে সরকার থেকেও বিভিন্ন কৃষি উপকরণ পান কৃষকেরা। পুরনো চাষিরা দক্ষ হন, সুকৌশলে লস মিনিমাইজ করতে পারেন। আমারও কৃষিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। সেটা কাজে লাগিয়ে লোকসান মিনিমাইজ করি। কৃষি থেকে বেশ লাভও করি। মাছের খাদ্য কিনতে পলিসি থাকতে হয়, একজন নতুন খামারি সেটা বুঝেন না। মাছ বিক্রিতেও পলিসি থাকে। আমরা সবকিছু বুঝেশুনে করি। যে কারণে আমাদের লোকসান হয় না। খাদ্যের দাম বেশি হলেও মাছের দাম এবার বেশ ভালো। ফলে খামারিদের লাভও হচ্ছে অনেক বেশি।
[৮] মাছ চাষে এতো বড় সাফল্য মিললো কীভাবে? জানালেন সে কথা। বলেন, কোয়ালিটি মাছ চাষ। আমরা তেলাপিয়া মাছ চাষ করি। তেলাপিয়ার রেনু পোনা আনি। এনে বড় করি। যখন ১০-১৫টা মাছে কেজি হয় তখন চাষে দিই। ছোট মাছের খাদ্য কম লাগে। খরচও কম হয়। অনেকে রেনু পোনা না এনে ১০, ১৫ বা ২০ টাকা দিয়ে একটা মাছ কিনেন। আমরা দুই টাকা দিয়ে পোনা কিনি। দু’তিন মাস পালি। ২ লাখ ছোট মাছ বড় করছি। এতে খাবার কম লাগে। এ পলিসিটা অনেকেই জানেন না। চারা মাছ বিক্রি করেও আমরা লাভ করি।
[৯] জানালেন, প্রায় ৬০ লাখ টাকা খরচ বা বিনিয়োগ করে প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর ৩০-৩৫ লাখ টাকা নীট আয় করেন। বছর শেষে গরুর খামার ও মাছের প্রজেক্ট থেকে প্রায় কোটি টাকা আয় হয়ে থাকে তার। কৃষি ও জনপ্রতিনিধির সেবামূলক দায়িত্ব দুটিকে কীভাবে সমন্বয় করেনÑ এ প্রশ্নের জবাবে এ চেয়ারম্যান বলেন, খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠি। নামাজি পড়ি। শরীরচর্চাও বাদ যায় না। সকাল আটটার আগে তিন কিলোমিটার হেঁটে মাছের প্রজেক্ট দেখে আসি। সমস্যা থাকলে সমাধানের পথ দেখিয়ে ফিরি। জনগণ জানে, সকাল আটটার পর থেকে ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করি আমি। উপজেলায় কাজ থাকলে চলে যাই। ফিরে এসে আবারও মাছ এবং গরুর প্রজেক্ট দেখি। বিকালে নিকটবর্তী বাজারের অফিসে বসি। জনগণ সেবা নিতে আসেন। যার যেটা দরকার সেটা করে দিই। কৃষি ও সেবামূলক কাজ সমন্বয় করেই চলে আমার। দুটি একসঙ্গে করতে গিয়ে এখনো পর্যন্ত বড় কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।
[১০] গরুর খামারও আছে এখন ফজলুল করিম দর্জির। খামারে ১২টি গরু আছে। গরুগুলোর দাম ১০ লাখ টাকার মতো। একজন কর্মচারী গরুগুলো দেখেন। নিজেও সময় দেন। গরুর খামারের অবকাঠামো তৈরি আছে। আগামী ১ বছরে একশ গরু আনবেন খামারে। গরুর চিকিৎসকও আছেন। কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপত্র দেন তিনি। নিজেই দেখে শুনে ভালো গরু বাছাই করেন।
ইউনিয়নের জনগণকে কৃষি কাজে উদ্বুদ্ধ করেন জানিয়ে ইউপির এই জনপ্রিয় চেয়ারম্যান বলেন, কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাছ চাষ, গুরুর খামার, ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করি। কৃষকেরা বিভিন্ন পরামর্শ নিতে আসেন। সাধ্যমতো সহায়তা করি। মাঝেমধ্যে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা ইউনিয়ন পরিষদে আসেন। ইউপি সদস্য ও কৃষকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কৃষি বিষয়ে সেমিনার, আলোচনা সভা করা হয়। কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সেমিনার করে থাকি। দুই বা তিন মাস পর পর এই কর্মসূচি নিয়ে থাকি আমরা।
[১১] ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী কৃষি নিয়েÑ এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ঘুরঘার বিলে ২০০শ কানির বিশাল একটা জমি বা মাঠ আছে। এই জমি নিয়েও ব্যাপক পরিকল্পনা আছে। কৃষকেরা ইরি ফসল ফলানোর পর বর্ষায় জমিগুলো প্রায় অনাবাদী থাকে। গণভিত্তিতে জমিতে মাছ করবো আমরা। কৃষকদের নিয়েই। জমি যার যতোটুকু, সমান লাভ পাবেন। কৃষকেরা এ ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহী। এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা অনেক কৃষক স্বাবলম্বী হয়ে উঠবেন।
[১২] একজন রাজনীতিবিদও সফল হতে পারেন কৃষিতে। কীভাবে সম্ভব হলো। কৃষিতে আপনার এ সাফল্যের ম্যাজিকটা কী? এ ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ১৯৭৪ সালে কৃষি বাদ দিয়ে বিদেশে যাওয়ার পরে উপলব্ধি হলো, টাকা খরচ করে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। বিদেশে যাওয়ার সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে দেশে থেকেও স্বাবলম্বী হওয়া যেতো। বিদেশে যাওয়ার খরচ তুলতেই দুই বছর লেগেছিলো আমার। এগারো বছর বিদেশে নষ্ট করেছিলাম। একসময় এটা বুঝতে পারি, বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমার ভুল ছিলো।
তখন নগদ অর্থ ছিলো না ঠিকই, তবে কোনো ব্যাংকের সহযোগিতা নিয়ে চাষবাস অব্যাহত রাখলে আরও সফল হতাম। আমার অর্থনৈতিক সাফল্য আসে মূলত বিদেশ যাওয়ার আগে ও দেশে ফেরার পরে। এখন আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল আছি। কর্মচারীরাও ভালো আছে। ছেলেমেয়েরাও কৃষিতে সহযোগিতা করে। কৃষিতে তারা সময়ও দেয়। পড়ালেখা করলেও কৃষি কাজ করতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। কৃষিতে সময় দিলে, লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কৃষিতে আনন্দ আছে। কৃষিতে ম্যাজিক আছে। কৃষিতে গর্ব আছে। কৃষিই বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখে। ফলে কৃষির প্রতি অকৃতিম ভালোবাসা থাকা দরকার সবার। সবসময়।
বিশেষ এই প্রতিবেদন তৈরিতে সার্বিকভাবে
সহযোগিতা করেছেন, ফখরুল ইসলাম