একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কী করে সফল করা যায়?
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
বাংলাদেশে কিছু সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে যেমন বাংলাদেশ কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ। এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৭৩ সালে অর্থাৎ বাংলাদেশ জন্মের দুই বছরের মাথায় এবং বঙ্গবন্ধু এর দায়িত্ব দিয়েছিলেন ড. মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদা। ড. কুদরত-এ-খুদা অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের খুবই প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার একদম কেন্দ্রে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। ভিতরে সুন্দর ভবন, সবুজে ঘেরা পরিবেশ। বাংলাদেশের অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো এটিরও সেরা সময় ছিলো তার প্রথম ডিরেক্টর ড. কুদরত-এ-খুদার সময়েই। ঠিক যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সেরা সময় ও সেরা অর্জন ছিলো তার প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর পি জে হার্টগের সময়। তারপর থেকে যত সময় গিয়েছে ততো অধঃপতন হয়েছে।
এটির সমস্যা কোথায়? বাহির থেকে এর অবকাঠামো ঠিক আছে। বাহির থেকে দেখতে এটি কলকাতার যেকোন সফল গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স বা দা ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স ইত্যাদির মতোই। পার্থক্য হলো উপরের আর ভেতরের মানুষের গুনে মানে। পৃথিবীর যেকোনো সফল প্রতিষ্ঠানের জনবলের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের জনবল দিয়ে প্রতিস্থাপন করলেই এটি অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এই প্রতিষ্ঠানে গবেষণার জন্য বিশ^মানের যন্ত্রপাতির অভাব নেই। কিন্তু ব্যবহার করার মতো মানুষ নেই। পার্থক্য এখানেই। হবে কীভাবে? এর অর্গানোগ্রামের দিকে তাকান। বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এর তুলনা করুন তাহলেই বুঝে যাবেন কেন এটি সফল হচ্ছে না। এর অর্গানোগ্রামের গবেষকদের পদের নাম কী? সায়েন্টিফিক অফিসার, প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার, চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার ইত্যাদি। বিজ্ঞানী বা গবেষকরা কখনো অফিসার হতে পারে না। পৃথিবীতে একটা গবেষণা ইনস্টিটিউট দেখান যেখানে গবেষকদের অফিসার বলে। বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনেও একই অবস্থা। একদম একই অর্গানোগ্রাম এবং সেটির অবস্থাও দিন যত যাচ্ছে ততোই অধঃপতিত হচ্ছে। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পদের নাম হবে অধ্যাপক বা গবেষণা অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক (রিসার্চ), সহকারী অধ্যাপক (রিসার্চ) ইত্যাদি। এর প্রমোশন ক্রাইটেরিয়া ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই।
একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মূল কার্যক্রম কী হবে? গবেষণা। এই গবেষণা হবে অধ্যাপকের নেতৃত্বে একদম সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, পোস্ট-ডক ফেলো এবং পিএইচডি প্লাস মাস্টার্স এর শিক্ষার্থী। এই প্রতিষ্ঠান বা এর মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমস্যা হলো এর উপরে সাওয়ার হয়ে বসে আছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সব সময় এই প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তাদের তাদের অধীনস্ত ভাবে। যারা গবেষণা করবে, যারা জ্ঞান সৃষ্টি করবে তাদের থাকবে তাদের ন্যূনতম যোগ্যতা থাকবে পিএইচডি, অনেকের থাকবে পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা আর যারা তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যদি কম থাকে তখন কনফ্লিক্টতো অবসম্ভাবী। হতো না। যদি মন্ত্রণালয় তাদের অধীনস্থ না ভেবে দেশের কল্যাণের কথা ভেবে তাদের সার্ভিস দিয়ে যেত। এখন ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্স যদি দেখেন সেখানে উচ্চ শিক্ষিত এই কর্মকর্তাদের অবস্থান কোথায় আর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অবস্থান কোথায়। অথচ এটি প্রতিচালনার জন্য একটি স্বাধীন পরিচালনা বোর্ড বা গভর্নিং বোর্ড। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রমোশনের জন্য স্বতন্ত্র স্বাধীন নিয়োগ ও প্রমোশন বোর্ড যেখানে মন্ত্রণালয়ের কোনো রকম ভ‚মিকা থাকবে না। তারা কেবল অর্থ ও স্বাচিবক কাজে সহযোগিতা করবে।
বর্তমানে এক্সিস্টিং অর্গানোগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে যতগুলো গবেষণা প্রতিষ্ঠান হয়েছে তার সবগুলো ব্যর্থ। বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ নামক এই প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি একটা উদাহরণ হিসাবে। আমাদের আমাদের পাশের দেশের নেয়ারেস্ট নেইবার, পশ্চিমবঙ্গের সফল গবেষণা প্রতিষ্ঠান কীভাবে সফল হয়েছে, সেই সিঁড়ি দ্বারা আমাদের বর্তমান সিঁড়িকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। জনবল নিয়োগ ও প্রমোশনে আন্তর্জাতিক নিয়ম মানতে হবে। আর সব শেষে সবচেয়ে গরুত্বপূর্ণ যেটি সেটির কথা এখন বলি। একজন অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক কিংবা সহকারী অধ্যাপক লেভেলের বিজ্ঞানী যার পিএইচডি আছে, যার পোস্ট-ডক আছে যিনি জ্ঞান সৃষ্টি অর্থাৎ গবেষণার সঙ্গে জড়িত তার বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি যদি সরকারি সাধারণ কর্মকর্তাদের স্কেলে হয় এমনকি তখনো (গাড়ি, ড্রাইভার, তেল ইত্যাদি সুবিধা ছাড়া) তাহলে বুঝতে হবে এই রাষ্ট্রের সিরিয়াস প্রবেøম আছে। এই রাষ্ট্রে শিক্ষা ও গবেষণা জিন্দেগিতেও ভালো হবে না। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়