বিজ্ঞানের সৌন্দর্য, ‘সংশয়’ এবং বস্তুর সত্যই বিজ্ঞান
আহসান হাবিব
বিজ্ঞানের সৌন্দর্য শুধু তার আবিষ্কারে নয়, তার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য সংশয় রাখার চৈতন্যে। এটা শুধু সৌন্দর্য নয়, এটাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি।বড় বড় বিজ্ঞানীদের আর একটি সৌন্দর্য হলো সত্যের প্রতি অবিচল থাকা এবং নিজেদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকা। তারা যে নির্ভুল, এই ধারণা তার পোষণ করেন না। তারা শুধু তাদের প্রাপ্ত ফলাফল প্রকাশ করেন এবং তা প্রমাণের মধ্য দিয়ে নিজের কাজের যথার্থতা প্রমাণ করেন। ডারউইন, ফ্রয়েড থেকে শুরু করে আইনস্টাইন সকলেই এই নীতি মেনে চলতেন এবং তাদের নৈতিকতার মান ছিলো সুউচ্চ। তারা সব সময় পূর্বগামীদের কাজের স্বীকৃতি দিতেন এবং তাদের কাজের কোনো অংশ কার কাছ থেকে নিয়েছেন, সততার সঙ্গে সেসব উল্লেখ করতেন। ডারউইন কিংবা ফ্রয়েডের যে কোনো রচনা পড়লে তার সত্যতা পাওয়া যায়। একবার আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত¡কে ভুল দাবি করে ১০০ জন বিজ্ঞানী বিবৃতি দিলে তিনি বলেছিলেন ‘১০০ জন কেন, ১ জনই যথেষ্ট, যদি বিষয়টি ঠিক হয়’।
বিজ্ঞানের সংশয় কি? আর কিছু নয়, অধিকতর সত্য আবিষ্কারের পথ খোলা রাখা এবং গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতি অবিচল থাকা । আজ যা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং সত্য বলে মনে হচ্ছে, আগামীকাল হয়তো তার চেয়েও সত্য আবিষ্কার হবে। নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্র আইন্সটাইনের দ্বারা আরও সঠিকভাবে সূত্রায়িত হয়েছে, তার মানে এই নয় যে নিউটন ভুল ছিলেন।
আবার সামাজিক বিজ্ঞানের দিকে তাকালে দেখা যায় হেগেল, ফয়েরবাখ যা করেছেন, তার উপর দাঁড়িয়েই মার্ক্স তার সঠিক মতবাদ হাজির করেছেন। তিনি তাদের মতবাদের ভুলটাকে সঠিকতার উপর দাঁড় করিয়ে বিজ্ঞানের মর্যাদা দিতে সক্ষম হয়েছেন। তার মানে এই নয় যে তারা ভুল ছিলেন। তারা তাদের সময় এবং সামাজিক জ্ঞানের, যা উৎপাদন ব্যবস্থার স্তরের সংগে সম্পর্কিত, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মতবাদ হাজির করেছিলেন। পণ্য অর্থনীতি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দর্শন রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে। মার্ক্স তাকে সমসাময়িক এবং বিজ্ঞানের ভিত্তির উপর দাঁড় করান। এটা কখনোই সম্ভব হতো না যদি মার্ক্সের আগে অসংখ্য দার্শনিক তাদের মতবাদ হাজির করতেন। ভাববাদের উপর বস্তুবাদের বিজ্ঞানময়তার জয় অনিবার্য ছিলো। মার্ক্স তার পতাকা উড়িয়েছেন। বিজ্ঞান একটি চিন্তার পরম্পরা এবং ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়া। বিজ্ঞানের চলমানতার অন্যতম চাবিকাঠি বস্তুর অসীম সত্য সম্পর্কে আস্থা এবং সংশয় রাখা। বার্ট্রান্ড রাসেল বলতেন ‘প্রতিষ্ঠিত সত্যেও কিছু সংশয় রেখে দেয়া ভাল’।
বিজ্ঞানের সংশয় আর প্রথাগত সংশয় এক নয়। বিজ্ঞানের এই সংশয় মানে অধিকতর সত্যের প্রতি আস্থা রাখা। বিজ্ঞান তাই কোনো ডগমা বা অন্ধ কুসংস্কার নয়। বিজ্ঞান কোনো পরম সত্যের ভবিষৎবাণী করে না। এই মহাবিশ্ব মুক্ত নাকি বদ্ধ, তা কেবল ভবিষ্যৎ গবেষণাই বলতে পারে। যদি মুক্ত হয়, যা এখনো এই নীতির উপর চলমান, তবে মহাবিশ্ব অনন্তকাল প্রসারিত হতে থাকবে, যদি বদ্ধ হয়, তাহলে প্রসারণ থেমে গিয়ে সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত এই মহাবিশ্বের শুরু বিংব্যাঙ দিয়ে বলা হয়, যদি এই সূত্র ভিল প্রমাণিত হয়, বিজ্ঞানই সবচেয়ে আনন্দিত হবে।
বিজ্ঞান অনড় কিছু নয়। বিজ্ঞান একটি চলমান প্রক্রিয়া। তার একটাই কাজ সত্য উদঘাটন করা। তবে আবিষ্কৃত সত্যের উপর অনড় থাকা নয়, বরং তার প্রতি সংশয় রেখে আরও সত্য আবিষ্কারে মগ্ন থাকা। অনেকে বিজ্ঞানের এই সংশয়কে বুঝতে পারে না, মনে করে এটা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। একদম ভুল, এটাই বিজ্ঞানের, আগেই বলেছি- সৌন্দর্য এবং শক্তি।
অধিবিদ্যা কিংবা ভাববাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের পার্থক্য হলো বিজ্ঞান বস্তু অতিরিক্ত কিছুতে আস্থা বা বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞান বলে চেতনা বস্তু থেকে আগত। বিজ্ঞান বস্তুবাদের নীতিতে চলে। বস্তুগত অবস্থান নেই এমন কিছু বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় নয়। ফুলের গন্ধ ফুল থেকেই আগত, বাইরে থেকে কেউ এই গন্ধ গুঁজে দেয়নি। ফুল ছাড়া গন্ধের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে আত্মা যা সজীব বস্তুর মধ্যে কোনো শক্তি প্রোথিত করে দেয় বলে ভাববাদীরা বলে, বিজ্ঞান তাকে নাকচ করে। আত্মা নামের বহিঃস্থ অস্তিত্বশীল কোনো শক্তি নেই যা বাইরে থেকে এসে ঢুকে বস্তুটিকে ক্রিয়াশীল করবে। এটা স্বয়ং বস্তুর বৈশিষ্ট্য। সজীব বস্তুর মৃত্যু হলে তার রূপান্তর ঘটে কেবল, আর কিছু নয়।
বিজ্ঞানের ইতিহাস বলছে তার প্রবাহমানতার বৈশিষ্ট্য। প্রশ্ন করাই তার প্রথম কাজ এবং উত্তর পেতে ক্রমাগত গবেষণা। আজ যতটুকু সত্য, আগামিকাল বিজ্ঞানই দেখিয়ে দেয় তার অধিকতর সত্য। বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় শক্তি জায়গাই হচ্ছে তার সংশয় রাখা এবং সংশয়ের বিপরীতে সত্য আবিষ্কারের নেশায় মেতে থাকা।
বিজ্ঞানের কোনো ধর্ম নেই, বিজ্ঞানীরও কোনো ধর্ম নেই। বিজ্ঞানের কাজ বস্তুর সত্য প্রকাশ করা এবং যিনি এই সত্য প্রকাশ করেন অর্থাৎ বিজ্ঞানী, তারও কোনো ধর্ম পরিচয় নেই। ধরুণ পানি বা জল বা ওয়াটার, এই বস্তুটির ভেতর কি কি উপাদান আছে, তার আবিষ্কার কোন ধর্মের ভাষার উপর নির্ভর করে না। এর আনবিক সঙ্কেত কোনো ধর্মকে নির্দেশ করে না। এবং কাজ কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা হয় না। একজন বিজ্ঞানীর ধর্ম বিশ্বাস থাকতে পারে, এটা তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা, কিন্তু বস্তুর কোনো ধর্ম বিশ্বাস নেই। জল বা পানির ধর্ম পৃথিবীর যে কোনো স্থানে এক। কোনো ধর্মবিশ্বাসী বিজ্ঞানীর জন্য এই পদার্থের কোনো বৈশিষ্ট্য পাল্টায় না। আমরা প্রায়ই শুনি মুসলিম বিজ্ঞানী কিংবা খৃষ্টান বিজ্ঞানী। এই নামকরণ হাস্যকর। প্রফেসর আবদুস সালাম একজন মুসলিম কিন্তু তার আবিষ্কার বা কাজ কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্য সাধন করে না। করে একটাই জিনিস তা হলো বস্তুর সত্য। ঠিক তেমনি ডারউইন না আইনস্টাইন কোনো ধর্মের তা তাদের আবিষ্কারের সঙ্গে কোনো সংযোগ স্থাপন করে না।
বিজ্ঞানের আছে বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি। এটা পৃথিবীর যে কোনো স্থানেই আবিষ্কৃত হোক না কেন। আপেক্ষিক তত্ত¡ আমেরিকায় এক রকম, বাংলাদেশে অন্য রকম নয়। যেমন আছে দর্শনের। যে কোনো দার্শনিক প্রত্যয় যে কোনো জায়গার জন্য প্রযোজ্য। হেগেল বলেছিলেন ‘যা কিছু অস্তিত্বশীল, তাই বিনাশের যোগ্য’। কথাটি সব সময় সব জায়গায় সত্য। বিজ্ঞান এই দার্শনিক সত্যকে আরও বস্তু সত্যে প্রকাশ করে, বলে ‘বস্তুর বিনাশ নেই, ভিন্ন শক্তিতে রূপান্তরিত হয়’। দুটিই সত্য- একটি দার্শনিক সত্য, অন্যটি বৈজ্ঞানিক সত্য। আই সি সি ডি আর বি’র যুগান্তকারী উদ্ভাবন ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট (ঙজঝ) পানিশূন্যতায় শুধু বাংলাদেশের মানুষের প্রাণ বাঁচায় না, পানিশূন্যতায় পৃথিবীর যে কোনো মানুষকে বাঁচায়।
মার্ক্সবাদ কোনো দেশের পুঁজিবাদ ব্যাখ্যা করে না, এটা ব্যাখ্যা করে পুঁজিবাদী পদ্ধতির তা পৃথিবীর যে কোনো জায়গার হোক না কেন এবং তার স্তর যাইই হোক। একটি পণ্যের মধ্যে উদ্বৃত্তমূল্য ধারিত থাকবেই এবং তা পুঁজিপতিরা আত্মসাৎ করবেই এবং তা পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রে। বিজ্ঞানের এই বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর বৈশিষ্ট্যের জন্যই তা নৈর্ব্যক্তিক। বিজ্ঞানের এই দ্বা›িদ্বকতা বস্তু এবং ব্যক্তির অবস্থানকে তুলে ধরে অসাধারণভাবে। ব্যক্তি আবিষ্কার করছে বস্তুর সত্য এবং আবিষ্কার করার পরপরই তা হয়ে পড়ছে নৈর্ব্যক্তিক। যে দেশ যত পিছিয়ে থাকে, সে দেশ ততো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দিক থেকে পিছিয়ে থাকে। তারা অন্যের আবিষ্কৃত বিজ্ঞান ব্যবহার করে। এই পশ্চাদপদতা তাদের ধর্মান্ধ করে তোলে, এটা তাদের মানসিক হীনমন্যতা। তারা বস্তুর সত্যকে কাছে থেকে দেখতে পায় না। ফলে তারা একই বস্তুকে বিভিন্ন নামে ডেকে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে। সা¤প্রদায়িক বিভাজন এবং সংঘর্ষ বাঁধানোয় ধর্মের কাজ।
বিজ্ঞান বিভেদ নয়, সৃষ্টি করে ঐক্য। বিজ্ঞান প্রকৃতির সত্যকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে তুলে ধরে। ধর্ম হচ্ছে অধিবিদ্যা, বিজ্ঞান বস্তুকেন্দ্রিক। ধর্ম তাই স্থির, বিজ্ঞান প্রবহমান। বিজ্ঞানের সত্য বস্তুর সত্য, ধর্মের সত্য ইউটোপিয়া, দৃষ্টিভ্রম।
লেখক: ঔপন্যাসিক