১০ নম্বর বিপদ সংকেত, মনে আছে কি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের কথা?
শরিফুল হাসান
সন্ধ্যার পর যতোই রাত গড়াতে থাকলো, ততোই ঝড় বৃষ্টি বাড় ছিলো। রেডিও আর টেলিভিশনে শুনছিলাম একের পর এক বিপদ সংকেত। ১, ২, ৩ করে ১০ নম্বর বিপদ সংকেত। একপর্যায়ে শুরু জলোচ্ছ¡াস। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের কথা বলছি। ৩২ বছর আগের কথা। কতো লাখ মানুষ মারা গিয়েছিলো সেই ২৯ এপ্রিলে? পাঁচ লাখ নাকি আরও বেশি? আজও মনে আছে আমার সেই ভয়াবহতার কথা। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ১৯৮৮ সালে আমাদের চট্টগ্রামে চলে যাওয়া। এর আগে আব্বা ছিলেন টিএসপি সারকারখানায়। সেখান থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার উল্টোদিকে আনোয়ারার ইউরিয়া সারকারখানায়। আমরা সেখানকার সরকারি কলোনীতে থাকতাম।
পতেঙ্গার উল্টোদিকে বঙ্গোপসাগর আর কর্ণফুলির মোহনায় এই কলোনি। ছিমছাম সাজানো এই কলোনি, ভেতরে বিশাল মাঠ, টেনিস কোর্ট, হাসপাতাল, স্কুল সবমিলিয়ে খুব সুন্দর। আমাদের বাসার একপাশের ছাদ থেকে বঙ্গোপসাগর আর কর্ণফুলির মোহনা দেখা যায়। আর পেছনেই ছোট্ট ছোট্ট টিলা। হাঁটা দূরত্বে মেরিন একাডেমি। রাতে ছাদে উঠলে আলোকিত চট্টগ্রাম দেখে মনে হয় এ বুঝি বিদেশের কোন শহর। সেই শহরে হঠাৎ একদন ঝড় আসলো।
তারিখটা এই ২৯ এপ্রিল। গত কয়েকবছর ধরে এই দিনের স্মৃতিচারণ করছি। আমার বয়স তখন আট। আজও মনে আছে প্রলয়ঙ্করী সেই রাতের কথা। সন্ধ্যার পব দমকা হাওয়া। ৬,৭, ৮, ৯ করে ১০ নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়া হলো। বাসায় আমি, আমার ছোট ভাই আর দুই বছরের বোন। আব্বা অফিসের কাজে চট্টগ্রামের বাইরে। বাসায় আমাদের পাহারা দিচ্ছেন শুধু আম্মা। রাতে যখন ১০ নম্বর বিপদ সংকেত দেওয়া হলো তখন আশপাশের সব বাসায় কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। সবাই বলছে ভয়াবহ ঝড়। সব মানুষ মরে যাবে। অবশ্য আমরা তখন বয়সে একেবারেই শিশু। আমাদের মধ্যে ওতো আতঙ্ক নেই। বরং এক ধরনের রোমাঞ্চ কাজ করছে। ঝড় হবে, জলোচ্ছ¡াস। না জানি কী হয়। আর সে কারণেই বোধহয় ঝড় শুরুর পর আমার ছোট ভাই বললো আম্মু পোলাও রান্না কর।
আম্মা সত্যি সত্যি সেই রাতে পোলাও রেঁধেছিলেন। আজ বুঝি আম্মা ভেবেছিলেন, ঝড়ে যদি মরে যাই। কাজেই বাচ্চাটার আবদার রাখি। ভাবলেই কষ্ট হয়। এতো দুশ্চিন্তার মধ্যেই সন্তানদের আতঙ্কটা বুঝতে না দেওয়া। লাইফ ইজ বিউটিফুল সিনেমাটার মতো। ঝড়ের রাতেই ফিরি। রাত যতোই বাড়ছে ঝড়ের তীব্রতা আর বাতাসের আওয়াজ বাড়ছে। সঙ্গে বৃষ্টি। কেউ কেউ আজান দিচ্ছে। দোয়া পড়ছে। আমার মমতাময়ী মা তার তিন শিশু সন্তানকে আগলে রেখেছেন। তিনিও দোয়া পড়ছেন। সঠিক সময়টা মনে নেই। ভোরের দিকে বোধহয়। ঝড়ের সঙ্গে এক ধাক্কায় জলোচ্ছ¡াসের পানি আসলে কলোনির মধ্যে। শুরু হলো নতুন আতঙ্ক।
আমাদের সরকারি কলোনীর চারপাশে বেশ উঁচু সীমানা দেওয়াল। সেই দেওয়ালের একপাশে একটা লেক। কাছেই বঙ্গোপসাগর। তীব্রবেগে জলোচ্ছ¡াসের পানি আসায় আমরা সবাই বুঝে গেলাম এবার আর বাঁচার উপায় নেই। মা আমাকে আজান দিতে বললো। আমাদের বাসা ছিলো দোতালায়। একতলায় ততোক্ষণে পানি। তারা সবাই আমাদের বাসায় চলে এসেছে। বাসার বারান্দায় গিয়ে আমিও সম্ভবত আজান দিয়েছিলাম। একসময়ে ভোরের আজান হলো। ঝড়ের তীব্রতা কমলো। সকালে আমি বাসা থেকে নিচে নামলাম। আমাদের সরকারি কলোনীতে কিছু গাছ পড়ে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। কিন্তু ছাদে উঠে আর কলোনির বাইরে গিয়ে দেখলাম লÐভÐ চারপাশ।
ছাদে গিয়ে দেখি, অনেক গরু মরে কলোনীর সীমানা দেওয়ালে আটকানো। জাহাজ উড়িয়ে সাগর থেকে নাকি মাটিতে নিয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে খবর আসলো। ১১ নম্বর ফেরিঘাট বিধ্বস্ত। এই ফেরিঘাট দিয়ে আমাদের সরকারি গাড়িগুলো পতেঙ্গা থেকে কলোনীতে আসতো। একটু সকাল হলে আমি আর আমার স্কুলের এক বন্ধু রিপন মিলে হাঁটু পানির মধ্যে দিয়ে কলোনী থেকে বের হলাম। কলোনীর মূল গেটে যেতেই দেখি সাপ মরে পড়ে আছে। পানির মধ্যে অনেক মরা মাছ। কলোনী থেকে বের হয়ে গ্রামের দিকে হাঁটা দিতেই মানুষের আহাজারি। কতো মানুষ যে মারা গিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। বেরিয়ে আসছে মানুষের রাতভর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা কাহিনী।
আমার আব্বা বাসায় এলেন দুদিন পর। বাসায় এসেই আমাদের তিন ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরলেন। আব্বা জানালেন, ঝড়ের পর টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। কারণ আমাদের কলোনাীর টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রেডিওর খবর আর খবরের কাগজে দেখে জেনেছেন চট্টগ্রাম বিধ্বস্ত। লাখো মানুষের মৃত্যু। তিনি ধরে নিয়েছেন আমরা সবাই মারা গেছি। তবে ফেরিঘাটে আসার পর সেখানে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা আব্বাকে জানান, কলোনীতে কোনো ক্ষয়খতি হয়নি। কিন্তু আমাদের কলোনীতে ক্ষয়ক্ষতি না হলেও চট্টগ্রামে উপক‚লীয় এলাকায় চলছে আহাজারি। রোজ খবরে আসছে ভয়াবহতা।
প্রথম দিন থেকেই শুরু হলো সরকারি ত্রাণ তৎপরতা। আনোয়ারায় সরকারিভাবে থাকার সবচেয়ে ভালো জায়গায় আমাদের সরকারি কলোনী। পরদিনই বা কয়েকদিন পর আমাদের স্কুলে সেনাবাহিনী ক্যাম্প করলো। ডাক্তাররা আসলো। আমাদের স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো। শত শত মানুষকে সেখানে চিকিৎসা আর আশ্রয় দেয়া হয়েছে। মাথার উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে। হেলিকপ্টারে আসে ত্রাণ। মানুষ কাড়াকাড়ি করে সেই ত্রাণ নেয়। আমি টেলিভিশন আর পত্রিকায় সেসব ছবি দেখি আর কষ্ট পাই।
২৯ এপ্রিলের সেই ঘুর্ণিঝড় স্থায়ীভাবে আমার মনে দাগ কেটে আছে। এই ঘটনার নয় বছর পর আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিকে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হততোদিনে আমার চট্টগ্রামের অনেক বন্ধু হয়ে গেছে। কক্সবাজার, চকোরিয়া, মহেশখালী, সীতাকুÐ, স›দ্বীপ, বাঁশখালী নানা উপজেলার বন্ধু। আমি ওদের মুখে ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহতা শুনতাম আর ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত।
আমার চট্টগ্রামের বন্ধুরা বলতো প্রায় সব পরিবারেই কেউ না কেউ হারিয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজার, মহেশখালী, চকোরিয়ায়। আমি এসব এলাকায় যখন কারও বাড়িতে বেড়াতে যেতাম ওরা আমাকে বলতো, এই গ্রামের এতো হাজার মানুষ মারা গেছে। আমি শুনতাম আর শিউরে উঠতাম।
পরবর্তী জীবনে সাংবাদিক হিসেবে আমি যখনই সিডর বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাভার করেছি আমার ২৯ এপ্রিলের কথা মনে পড়েছে। আসলে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবাইকে মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির কাছে আমরা আসলেই অসহায়। মুহুর্তেই শেষ হয়ে যেতে পারে সবকিছু। আবার দুর্যোগ এটাও শেখায় পরষ্পরের পাশে থাকতে হবে। সবাই মিলে বাঁচতে হবে। এটাই মানবতা।
৩২ বছর পর আজ ২৯ এপ্রিলের কথা স্মরণ করে মানবতার সেই ধ্বনিই প্রতিধ্বনি করতে চাই। আসলে সবাই মিলে বাঁচার কোনো বিকল্প নেই। আর পৃথিবী তো এই বার্তাই আমাদের দিতে চায় যে আমরা যেন প্রকৃতির যতœ নেই। সবাই মিলে বাঁচি। আল্লাহ আমাদের রহম করুন। ভালো থাকুক গোটা পৃথিবী। ভালো থাকুক সব মানুষ ও প্রকৃতি।
লেখক: অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান, ব্র্যাক