বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন কেমন আছে?
কাজী এম. মুর্শেদ
আমাদের দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদরা কি সামনে যে সমস্যা আসছে, সেটা বোঝেন না, নাকি বলতে চান না। না বলার কারণ দুইটাÑ এক. পদ-পদবি, পদকের লোভ। দুই. উনারা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ভয়ে থাকেন। তবে সম্ভাব্য কারণ বাংলাদেশে অর্থনীতি যারা ভালো বোঝেন, তারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, আর কম বোঝেন, তারা ডেটা এনালাইসিস করে ভ্যালিডেশন করতে জানেন না, ফলাফল কখন অর্থনীতি মন্দা আসতে পারে, তা বলেন না। বলেন না, কারণ জানেন না!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমন বলেছিলেন, পদ্মা সেতুতে নিয়ে দুইটা চুবানি দিবেন! অবশ্যই ভিজ্যুয়ালাইজ করেন না। কারণ সেটা উনার হিউমারের অংশ, আমার মনে হয় বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদেরও যদি উনি বুড়িগঙ্গার কালো কেমিক্যাল পানিতে নিয়ে চুবাতেন, একটু কাজ হতো! আমি সাংবাদিকদের অনেক গালি দিই, তারা সব বিষয়ে যেমন বিশেষজ্ঞ হয়ে কথা বলেন, বকা খাওয়ার মতোই কাজ! তারপরও বলবো, সাংবাদিকরা দেশ-বিদেশের অর্থনীতি লিখলে, আমাদের স্বনামধন্যদের চেয়েও ভালো লিখতেন।
আপনি শুধু ডিমান্ড-সাপ্লাই শিখে অর্থনীতিবিদ বুঝবেন না। অনেককিছু নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা, ব্যাংকের মুদ্রানীতি, আমদানি রফতানি ও ব্যালান্স অফ ট্রেড ও পেমেন্ট, কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশন, ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ, বৈদেশিক লোনের সময়, সুদ, রিপেইমেন্ট, ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট, ইনফ্রাস্ট্রাকচার, বাজেটের ডেভেলপমেন্ট খাত, সরকারি কর্মকর্তা ও সুদ পেমেন্ট বা অনুৎপাদনশীল খরচের রেশিও, ডেফিসিট বাজেট, অভ্যন্তরীণ আয়ের খাত, এমন অনেক অনেক বিষয়ে হিসাব মিলালে তখন সার্বিক চিত্র বোঝা যায়।
আজকাল ক‚টনীতিক সম্পর্ক বলে কিছু নেই, পুরোটাই অর্থনৈতিক কুটনীতিক সম্পর্ক। আর একবার বললে হয়তো মামলা খাবো, তারপরও বলি, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরীতা নেইÑ এই ইউটোপিয়ান ধারণা পুরো অচল। আগেও অচল ছিলো এখনো অচল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছর আরেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, আমেরিকা চীনের পিংপং কুটনীতি। দুটো দেশই বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলো। কারণ তারা অর্থনীতিতে কাছাকাছি আসছিলো, আমরা রাশিয়ার সাহায্য যা পেয়েছে তার মূল কারণ তারা পিংপং কুটনীতি পছন্দ করেনি। এরপর একদিন সময় নিয়ে পড়ে দেখেন। বিশ্ব অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে বুঝবেন।
আমি ডাচ ডিজিস নিয়ে আগেও লিখেছি, এখনো এর থেকে সরবো না। আমরা ভয়ংকর এক রাস্তায় চলছি। বাংলাদেশের যে চারখাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসতে পারে তাও ব্যাখ্যা করে বলেছি, এর মধ্যে দুইটায় বেশ খারাপ অবস্থায় আছি। আমাদের ইনওয়ার্ড রেমিটেন্স কোনো কারণে আটকালে বা কমলে যেই বিপদে পরবো, সেটা অর্থনীতিবিদরা দেখছেন না। ৮০ শতাংশ রফতানি ডিপেনডেন্সি তৈরি পোশাকে, একটা ধাক্কা আসলে কী হতে পারে কোনো ধারণাই করতে পারছেন না।
ফরেন কারেন্সি ধরে রাখতে ইম্পোর্ট কমানো কোনো সমাধান না। এইটা কাউকে বলতে শুনেছেন? ইম্পোর্ট কমানো মানেই এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য শিল্প সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসেন একটা উদাহরণ দিই। ধরেন, মুরগির খাবার আনা বন্ধ করা হলো, মুরগির চাষ ও ডিমের চাহিদা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পুষ্টিহীনতায় অসুস্থ বাড়বে, এর জন্য অতিরিক্ত খরচ বাড়বে, ওষুধের চাহিদা বাড়বে, সেটার কাঁচামাল আনতে যা খরচ হবে তার চেয়ে মুরগির খাদ্যের খরচ কম।
আমি আপাতত তিনটা খাতে এখনো খরচ কমার রাস্তা দেখি, আমাদের অর্থনীতিবিদেরা সেইগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। [১] আউটওয়ার্ড রেমিটেন্স, যারা বিদেশি ম্যানেজমেন্ট রেখে ব্যবসা চালায়। তাও কোনো বড় উন্নতি করতে পারেনি। [২] বিদেশ ভ্রমণ কমানো, সরকারের সঙ্গে এতো শত লোক কী কারণে বিদেশে যান জানা নেই। [৩] চিকিৎসা খাতে ভারত, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর যাওয়া। প্রয়োজন হলে একটা ভালো হাসপাতাল করে সেখানে এইসব বিশেষজ্ঞ আনলে খরচ কম হতো। তিনটা উদাহরণ বললাম, আমাদের অর্থনীতিবিদদের এমন চোকলিস্ট তৈরি করে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলতে হবে, সরকারকে সেটা শুনতে হবে এবং কাজ করতে হবে। আরও চান? অপ্রয়োজনীয় বিদেশি ঋণ প্রজেক্ট, হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ করা, বেগমপাড়ায় পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা, লিস্ট অনেক লম্বা।
আপনারা শুনছেন টাকা জনগণের জন্য খরচ হয়েছে, করোনার টিকা কিনতে খরচ হয়েছে। ভালো কথা। আমরা কতো টিকা বিনামূল্যে পেয়েছি জানেন। টিকা কিনতে পয়সা খরচ না হলে টাকা কই, আর টাকা গেলে টিকা ফ্রি কেমনে হয়? হোজ্জার সেই বিড়াল আর মাংসের গল্প মনে আছে? কোন মন্ত্রণালয়ে কতো দুর্নীতি এইসব টিআইটির ইফতেখারুজ্জামান, সুজনের বদিউজ্জামান বা সিপিডির দেবব্রত ভট্টাচার্য সবই এখন ওই বাস্কেটের অংশ যাঁদের বুড়িগঙ্গায় স্নান করে পরিশুদ্ধ করতে হবে। আরও অনেক অপ্রয়োজনীয় গোষ্ঠি আছে, সেটা সংস্কৃতিক জোট বা এফডিসির সেন্সর বোর্ড, এমনকি চাঁদ দেখা কমিটিও এইসব খরচের জায়গা।
খরচ কমানো কঠিন না, কিন্তু লিডার লিড বাই এক্জামপল কথাটা বলেছিলাম, সেইটা তৈরি করতে না পারলে কি করার আছে? ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো, যা চিকিৎসা হোক দেশেই নেবো এমন কয়জন পাবেন? চোখ দেখাতে ইংল্যান্ড, চশমা কিনতে জার্মান, কাঁচ লাগাতে বেলজিয়াম, সঙ্গে বিশাল বহর, এইটা কী রে ভাই?
শেষে কয়েকটা তথ্য দিই, যেটা জিয়া হাসান থেকে নেওয়া। ডাচ ডিজিজের সকল ক্রাইটেরিয়ায় আমরা আছি। তৈরি পোশাকের উপর ৮০ শতাংশ রফতানি আয়নির্ভর করে। এখানে একটা ছোট ধাক্কা যদি আমেরিকা থেকে আসে, ৩১ শতাংশ ব্যবসা কমে যাবে। নতুন বাজার খোঁজা হয়নি করোনা আর ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার আগে নীচের হিসাব খেয়াল করে পড়েন, [১] গার্মেন্টস শিল্পে ২৫ শতাংশ মালিক অর্থ সংকটে রয়েছে। [২] ক্রেতারা কার্যাদেশ দিয়েও টালবাহানা করছে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে। [৩] তৈরি পোশাক উৎপাদন কমেছে ৩০ শতাংশ। [৪] কার্যাদেশ কমেছে ৩০ শতাংশ। [৫] টেক্সটাইল খাতে উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ। [৬] অর্ডার অনুযায়ী পাঠানোর পরও পেমেন্ট মিলছে না ৬০ শতাংশ। এখন বলেন গার্মেন্টস শিল্প বাঁচানো আমাদের প্রথম কাজ নাকি মেট্রোরেল, পাতাল রেল বা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের মতো মেগা প্রজেক্ট চালানো?
লেখক: অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষক