রাজেকুজ্জামান রতন, সহসাধারণ সম্পাদক, বাসদ দেশে মুদ্রাস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশেরও বেশি, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ, এতে শ্রমিকেরা তাদের প্রকৃত মজুরি হারান
ভূঁইয়া আশিক রহমান : বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ১৩৭ বছর আগে শ্রমিকেরা দাবি তুলেছিলেন, ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা বিনোদন। ১৩৭ বছর পরে আবারও আমাদের দাবি তুলতে হচ্ছেÑ যে মজুরি পাচ্ছি, তাতে আমাদের জীবন চলে না। ফলে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ব্যবস্থা করতে হবে এবং জীবন যাপন করতে গিয়ে আরও যেসব প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, শ্রমের মাধ্যমে মজুরিপ্রাপ্ত হয়ে শ্রমিকেরা যেন তাদের জীবনটা বিকশিত করতে পারেন, তাদের সন্তান-সন্ততির শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে, নিজেদের বৃদ্ধ বয়সে নিরাপদে থাকতে পারেন, সেই পরিমাণের মজুরি এখন তারা দাবি করছেন।
আমাদের অর্থনীতিকে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে বলা হয়, বিশে^র সবচেয়ে সস্তা শ্রমিকদের দেশ। শ্রমিকের শ্রম খুব সস্তা। কিন্তু বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য এখন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেটা খাদ্যের মূল্য হোক, সেটা বাসাভাড়া হোক, এমনকি সেটা জমির মূল্যও হোক। শ্রমিক যা বিক্রি করেন, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে সস্তা, আর শ্রমিক যা খেতে চান, শ্রমিক যেভাবে জীবন যাপন করতে চান সেভাবে পারেন না। কারণ সবকিছুরই মূল্য বেড়েছে অনেক। ফলে মজুরি ও মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না শ্রমিকেরা। রাষ্ট্রের হিসাব অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশেরও বেশি। আর শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। ফলে প্রতি বছর শ্রমিকেরা টাকার অংকে যে মজুরি পাবেন, সেটাও কিন্তু প্রকৃত মজুরি হারান তারা। মুদ্রাস্ফীতির কারণে ১০০শ টাকার জিনিস তাকে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় কিনতে হয়। আর বেতন হয় ১০৫ টাকা। তার মানে ৪ টাকারও বেশি শ্রমিক মজুরি হারাচ্ছেন। এজন্য শ্রমিকদের মধ্যে শুধু পুষ্টিহীনতাই দেখছি না, অসন্তুষ্টিও লক্ষ্য করছি।
রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, জীবন হারানো, পঙ্গুত্ব হওয়া, শ্রমিকদের দুঃষহ পরিস্থিতি, তাদের পরিবারের অসহায় অবস্থা আমরা সবাই দেখছি। যে শ্রমিক কাজ করেন জীবনকে বিকশিত করার জন্য কর্মক্ষেত্রে আসেন, তার মারা যাওয়ার মধ্যদিয়ে পরিবার অসহায় হয়ে যায়। আর আহত হলে তিনি তার পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়ান! ফলে দীর্ঘদিন ধরে দাবি ছিলো, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের মৃত্যুতে আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকেরা আহত হলে তার চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে হবে। এই ন্যায্য দাবিটা শ্রমিকেরা এখনো আদায় করতে পারেননি।
বাংলাদেশে ৭ কোটি ৩৪ লাখ শ্রমশক্তি আছে। কিন্তু আমাদের গার্মেন্টসে শ্রমশক্তির পরিমাণ ৪০ লাখের কাছাকাছি। আর গার্মেন্টস খাত থেকে আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে। গার্মেন্টস একটা গেøাবাল পণ্য। কিন্তু শ্রমিকেরা লোকাল মার্কেটে শ্রমশক্তি বিক্রি করেন। দেশে শ্রমশক্তি বিক্রি করেন শ্রমিকেরা আর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য বিক্রি হয়। তাহলে কেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়েও কম হবে? এই দাবিটা শ্রমিকেরা তুলেছেন।
আমাদের দেশে মজুরি নির্ধারণের জন্য সরকার নির্ধারিত ৪৩টি মজুরি বোর্ড আছে। প্রতি ৫ বছর পর পর মজুরি নির্ধারণের কথা। কিন্তু ৫ বছরে তো দ্রব্যমূল্য এক জায়গায় থাকে না। ফলে ৫ বছর পরে যে মজুরি নির্ধারিত হয়, সেটা শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমেই যায়। কারণ ৫ বছরে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যে জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়, মজুরি সেই পরিমাণে বাড়ে না। আমরা তাই দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতি বছর মজুরি নির্ধারণের দাবি জানিয়েছি।
দেশের শ্রমজীবী মানুষেরা মনে করেন যে তার যৌবনের শক্তি দিয়ে তিনি কাজ করেন, বৃদ্ধ বয়সে তাকে দেখবে কে? ফলে সর্বজনীন পেনশনের একটা ঘোষণা দেওয়া আছে। কিন্তু এই ঘোষণা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? তার রূপরেখা এখনো পর্যন্ত তৈরি হয়নি। এই পেনশনের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে জমা দিলে আঠারো-বিশ বছরের পর যেটা পাবে, সেটা কি গার্মেন্টেসের সকল শ্রমিকদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে? কারণ তার চাকরি তো অনিশ্চয়তার মধ্যে ঢাকা পড়ে আছে! যেকোনো সময় চাকরি চলে যেতে পারে। ফলে ধারাবাহিকভাবে, নিয়মিত পেনশনের টাকা জমা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বাড়াতে হবে। এবং একটা বিবেচনা করতে হবে যে, কেন শ্রমিকেরা তাদের সর্বজনীন পেনশনের জন্য নিয়মিত টাকা দিতে পারবেন না, তার কারণগুলো কীÑ সেসব দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।
বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। তাদের কাজ থাকে না ঠিকমতো। মজুরিও নির্ধারণ হয় না ঠিকমতো। তাদের নিয়োগপত্র, পরিচত্র নেই। নারী-পুরুষের শ্রম ও মজুরির মধ্যে বৈষম্য আছে। ফলে কর্মক্ষেত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক হওয়ার কারণে শ্রমিকদের জীবনের দুর্দশাটা আরও বেড়ে গেছে। সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানি-অপ্রাতিষ্ঠানিক মজুরির ক্ষেত্রে একটা সাধারণ জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার দাবি করেছেন শ্রমিকেরা।
দেশের শ্রমবাজারে নারী শ্রমিক ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি যেমন এখানে যুক্ত আছে, পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আছে। কারণ সমাজ কাঠামো ও মানসিকতা অনুযায়ী নারী শ্রমিকেরা প্রতিনিয়তই তাদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সেক্ষেত্রে আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন করে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা দরকার। যে আইন দিয়ে নারী শ্রমিকেরা ভাববেন, তাদের কর্মক্ষেত্র নিরাপদ। পথে চলতেও নিরাপদ বোধ করবেন। ফলে কর্মপরিবেশ নিরাপদ না হলে মানসম্পন্ন বা দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক পাওয়া যাবে না। যদি আমরা দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক পেতে চাই, যদি আমরা শ্রমিকদের মানসম্পন্ন জীবন পেতে চাই, তাহলে শ্রমিকদের জীবনকেও নিরাপদ করতে হবে। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দক্ষতা বাড়ে না। নারী শ্রমিকদের জন্য সহিংসতামুক্ত ও হয়ারানিমুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিও উঠছে।
মে দিবসের প্রধান প্রতিপাদ্য হওয়া দরকার, সকল কর্মসক্ষম মানুষের কাজের ব্যবস্থা করা। যাদের কাজ আছে, তারা ৮ ঘণ্টা কাজ করে যেন এমন মজুরি পান, যাতে তার সংসার চলতে পারে। কাজ হারানোর ঝুঁকি কমানো দরকার, যাতে কাজের স্থায়িত্ব বাড়ে। কর্মক্ষেত্রে যদি নিহত-আহন হন কোনো শ্রমিক, ক্ষতিপূরণের হারটা এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত, যাতে শ্রমিক তার বাকি জীবনটা নিরাপদে কাটাতে পারেন। শ্রমিকদের জন্য রেশন, আবাসন, পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী শ্রমিকদের জন্য ডরমিটরির ব্যবস্থা করা। তাদের সন্তানদের রাখার জন্য ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের শ্রম আইনের যে অগণতান্ত্রিক ধারা আছে, যে কারণে শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারছেন না, ট্রেড ইউনিয়ন থাকলেও সেটা চর্চা করতে পারছেন না, শ্রম আইনের অগণতান্ত্রিক ধারা বাতিল করে একটা গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ শ্রমজীবী মানুষের দেশ। শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নত হলে বাংলাদেশও উন্নত হবে। তা না হলে একদিকে শ্রমিকেরা শোষিত হতে থাকবেন, অন্য দিকে সমাজে বৈষম্য বাড়তে থাকবে। শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই মে দিবসের আবির্ভাব হয়েছিলো। ১৩৭ বছর ধরে শ্রমিকেরা লড়ছেন। এবারও শ্রমিকেরা সেই প্রতিজ্ঞাই নেবেন, বৈষম্যে ও শোষণের সমাজ পাল্টাতে হবে। শ্রমিক যেন শ্রম দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারেন, সেই রকম একটা জীবনের দাবিতে শ্রমিকদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।
একটা নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শ্রমজীবীরা মে দিবস পালন করতে যাচ্ছেন। মে দিবস শুরুর ১৩৭ বছরের পরে আবারও আমাদের দাবিটা তুলতে হচ্ছে যে, ৮ ঘণ্টা কাজ, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র। কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুজনিক কারণে আজীবন ক্ষতিপূরণ দেওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন চলছে না, ফলে রেশনের ব্যবস্থা করা। শ্রমিকেরা যে বেতন পান, মানসম্পন্ন বাসাভাড়া করে থাকা সম্ভব হয় না বলে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি উঠছে, ভালো আবাসানের ব্যবস্থা করার। শরীর সুস্থ করার জন্য প্রয়োজন হয় সুচিকিৎসা। সেই চিকিৎসা এতো ব্যয়বহুল হয়েছে যে, শ্রমিকদের দাবি তুলতে হচ্ছে চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।