সভ্যতার সংকট, বাণিজ্যনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথ
গোলাম সারোয়ার
‘সভ্যতার সংকট’ তত্ত¡টি প্রথম বলেন স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন ১৯৯৩ সালে। পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালে তিনি তত্ত¡টি অনেকটা খোলাসা করেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত এই অধ্যাপক সে সময় দেখলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ু শেষ হয়ে গেছে। নতুন বিশ্বব্যবস্থা তারপর হয়ে গেলো এককেন্দ্রীক শক্তির অধীন। আমরা জানি মানব সভ্যতায় সংঘাত অনিবার্য। যেহেতু বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এসে জগতে আর কোনো প্রকট আদর্শিক দ্ব›দ্ব রইলো না, সমাজতন্ত্র ধরাশায়ী, পুঁজিবাদ আর গণতন্ত্র নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী, সুতরাং বাকি থাকে ধর্ম আর সংস্কৃতি। হান্টিংটনরে মতেÑ সংস্কৃতি, মানে বিভিন্ন সভ্যতা একে অপরের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। তাঁর ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্তে¡র মূল কথা ছিলো মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে খ্রিস্ট দুনিয়ার সংঘাত হবে একুশ শতকের সংঘাতের নিয়ামক। হান্টিংটন আটটি সভ্যতার কথা বলেছেন। সেগুলো হলো, পশ্চিমা সভ্যতা, কনফুসিয়াস সভ্যতা, জাপানিজ, ¯øাভিক-অর্থোডক্স, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকান, হিন্দু আর মুসলিম সভ্যতা। তিনি মনে করতেন ধর্ম আর সংস্কৃতির নৈকট্যের কারণে বিভিন্ন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলো উল্লিখিত আটটি সভ্যতার ছত্রছায়ায় একত্রিত হবে।
তাঁর আগে ইতিহাসবিদ আরনল্ড টয়োনবি বিশ্বে বিরাজমান একুশটি সভ্যতাকে চিহ্নিত করেছিলেন। সেই একুশ সভ্যতা আজ বিলীন। হান্টিংটন থিওরির কিছুটা রূপ দেখা গিয়েছিলো রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত। রাশিয়া ইউক্রেন ছিলো একই সভ্যতার অংশীজন। মূলত রুশ সভ্যতার পূর্বসূরি ছিলো কিয়েভ সভ্যতা। সেই কিয়েভ এখন নিপীড়নের মুখোমুখি আছে স্বয়ং তার উত্তর-সভ্যতা রুশ কর্তৃক। তাইওয়ান চীন একই সভ্যতার অংশীজন। তারা আজ যুদ্ধের প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে।
স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের আগ পর্যন্ত পৃথিবীর হিসাব ছিলো ভিন্ন রকম। তখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে সৌদিআরব ছিলো আমেরিকার বন্ধু। আমেরিকার অস্ত্রের বড় ক্রেতাও ছিলো সৌদিআরব। তাদের নিরাপত্তাও দিতো আমেরিকান সৈন্যরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টের সহমর্মিতা হিসেবে আমেরিকা-ব্রিটেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি জন্ম থেকে আজ অবধি সমর্থন ধরে রেখেছে। ইসরাইলের সঙ্গে ধর্মীয় আর রাজনৈতিক কারণে ইরান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন আর লেবাননের হিজবুল্লাহদের শত্রæতার সম্পর্ক। আবার সৌদিআরবসহ সুন্নি দেশগলো ইরান, সিরিয়া, রাশিয়া আর চায়নার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার হুমকি দিয়েছিলো একসময়। ইরান একটি শিয়া অধ্যুষিত দেশ এবং তার রাষ্ট্রীয় আবেগ বিশ্ব থেকে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রকে মুছে দেওয়ার।
ইহুদিরা মনে করে, ইসরায়েল আদি সেমেটিক ইহুদিদের কল্পিত প্রমিজল্যান্ড। এই ভ‚মি তাদের দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলো তাদের আদিপিতা আব্রাহামকে স্বয়ং ঈশ্বর। তারা মনে করে জাতিতে তারাই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ। তাই সর্বশেষ নবী তাদের ভিতর থেকেই আসা সমীচীন। কিন্তু ইসলামের মহানবীর জন্ম হয় আরবে। তাই ইহুদীরা তাঁকে মেনে নেয়নি।
আবার ইরান আর সিরিয়া ধর্মবিশ্বাসে রাশিয়া আর চীনের শত্রæ থাকলেও রাজনৈতিক কারণে কাছাকাছি আসে। পরমাণু ইস্যুতে ইরান একঘরে হয়ে পড়লে দেশগুলো তাদের সাহায্য করে। রাশিয়ার অস্ত্রের ক্রেতা ইরান ও সিরিয়া। বিশ্ব তেল রাজনীতিতে এই দুটি দেশ রাশিয়ার সঙ্গে এক সুরেই কথা বলে। তার মানে ধর্মের কারণে রাষ্ট্রগুলো কাছাকাছি আসেনি। এসেছে অন্য কারণে। সমীকরণ দাঁড়ালো হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত তত্তে¡র কাজ সে সময়েও তেমন করেনি। আর রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের পর এখনতো পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গেছে। আমরা দেখেছিলাম স্নায়ুযুদ্ধের পর গত ত্রিশ বছরে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে ছিলো। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর মুসলিম বিশ্বে আজ চীন নতুন করে তাদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ডলার আজ তার নিরঙ্কুশ শক্তি হারাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের চীর বৈরি দুই দেশ ইরান-সৌদি আরব আজ একই কাতারে আসার দ্বারপ্রান্তে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির কারণ ছিলো ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের পত্তন। ইসরায়েলিরা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। তাদের কোনো রাষ্ট্র ছিলো না। একটি রাষ্ট্র পাওয়ার জন্য তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী চেষ্টা করে এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথসচাইল্ডকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠির বিষয় বস্তু ছিলো ইহুদীদের জন্যে একটি আবাসভ‚মি প্রতিষ্ঠা। এটাই ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা। তারপর ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিশর, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, ইরান ইসরাইল রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। সৌদিআরব তখন আরবদের পক্ষ নেয়নি। তারপর ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালেও আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইল রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেসব যুদ্ধের ফলে বিশাল আরব এলাকা ইসরাইলীদের দখলে চলে যায়।
ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইহুদিদের সংঘাত সুপ্রাচীন। তবে আজকের ইহুদিরা দাবি করে যে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষরা লড়েছিলো তারা হারিয়ে গেছে। এখন যারা ফিলিস্তিনি হিসেবে নিজেদের দাবি করে তারা মূলত আরব।
প্রাচীন হিব্রæ ইতিহাস মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের বহুপূর্বেই যারা জুড়িয়াতে বসতি স্থাপন করেছিলো তাদের রাজধানী ছিলো জেরুজালেম। তাদের নেতা মোজেস, তাদের পিতৃপুরুষ আব্রাহাম। তাদের রয়েছে লিখিত সাহিত্য, আইনগ্রন্থ, ক্যালেন্ডার, জ্ঞানগ্রন্থ, কাব্য, কল্পকথা, হিব্রæ বাইবেল। সে সময় ফারাও দ্বিতীয় নেকো আসিরীয় সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। জুডার রাজা তার বিরোধিতা করে যুদ্ধে রত হয়ে পরাজিত ও নিহত হয়। জুডা পরিণত হয় মিশরের করদ রাজ্যে।
আবার ব্যাবিলনের মহান সম্রাট নেবুচাদনেজার জেরুজালেম দখল করে পুড়িয়ে দেয়। যারা বেঁচে ছিলো তাদের বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে যায়। এরা ছিলো পিতা ইব্রাহিমের বংশধর, তাঁরপুত্র আইজ্যাক, তাঁরপুত্র জ্যাকবের বংশধর। চার শত বছর মিশরে দাসত্বের জীবন শেষে মোসেজের নেতৃত্বে তারা রেড সি পার হয়ে আসে। তখন গাজাসহ আশেপাশের এলাকা ছিল ঈজিয়ান গোত্রের লোকদের অধিকারে। এই ঈজিয়ান গোত্রের লোকেরাই ছিলো ফিলিস্তিনি। বহুবছর যাবৎ ইব্রাহিমের সন্তানদের এই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত থাকতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে তাদের রাজা সল তাদেরকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মাউন্ট গিলবোয়ার যুদ্ধে রাজা সলকে ফিলিস্তিনিরা শরাঘাতে হত্যা করেন। তার বর্ম ভেনাসের মন্দিরে সংরক্ষণ করা হয় আর তার দেহ বেথ শান মন্দিরের দেয়ালের সঙ্গে কিলক ঠুকে আটকে রাখা হয়। তারপর তাদের ইতিহাসে আসে ডেবিড, সলোমনের আমলে আরেক সমৃদ্ধ জীবনের। তবে হিব্রæ জনগণের সমৃদ্ধি ছিল ক্ষণস্থায়ী। ৭২১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আসিরীয় আক্রমনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্তিত্ব ইতিহাসের আবর্তে হারিয়ে।
আবার আসি বিংশ শতাব্দীতে। ১৯৯১ সালে মিখাইল গর্বাচেভ ধরাশায়ী হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হয়ে অনেক অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্নায়ু যুদ্ধের অবসান হয়। আমেরিকা এক কেন্দ্রীক বিশ্বের কেন্দ্রে চলে যায়। রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়। এখন চীন নিয়মিত চক্কর দিচ্ছে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে। পৃথিবী এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দায় মেটানোর দ্বারপ্রান্তে। তখন বিজয়ী পক্ষরা পরাজিত রাষ্ট্রগুলোকে তাদের রাজনৈতিক ছায়ায় ভাগ করে নেয়। তখন অক্ষশক্তির মূল কেন্দ্র পরাজিত জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কোরিয়া ভাগ হয় উত্তরে-দক্ষিণে। জাপান চলে যায় পারমাণবিক বোমায় যাদের হাতে পরাস্ত সেই আমেরিকার করায়ত্তে।
স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাস্ত হলে বার্লিন প্রাচীন ভেঙে দুই জার্মানি একত্রিত হয়। তারপরও প্রায় বত্রিশ বছর যায়। কিন্তু আমরা সভ্যতার সংঘাত হান্টিংটনের কল্পিত স্টাইলে পাইনি। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পরস্পর কাছাকাছি আসছে, অথচ ইউরোপের দুই দেশ যুদ্ধে রত হয়েছে স্বয়ং নিজ সভ্যতার বিরুদ্ধে। এশিয়ার এক সভ্যতার দুই দেশ চীন-তাইয়ান যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দুই কোরিয়া আজ যুদ্ধের মুখোমুখি। উত্তর কোরিয়া-জাপান মুখোমুখি। আফ্রিকার দেশগুলো দ্বিধাবিভক্ত, লাতিন আমেরিকা ইতস্তত, এশিয়ার দুই জায়ান্ট চীন-ইন্ডিয়া আজ মুখোমুখি, সিন্ধু সভ্যতার দুই অংশীজন ইন্ডিয়া-পাকিস্তান আজ চিরবৈরী।
আমরা আজ দেখতে পাই, পরস্পর কাছাকাছি থাকা ধর্ম কিংবা সংস্কৃতিগুলো একত্রিত হচ্ছে না। আমরা বরং দেখি, আরেক নতুন ওয়ার্ল্ড-অর্ডারের দিকে পৃথিবী যাচ্ছে। আমরা জানি পৃথিবীতে যাদের হেজিমনি টিকবে তাদের কেন্দ্র করেই পৃথিবীর অর্থনীতি আবর্তিত হবে। পৃথিবীতে রাজনীতি, সমরনীতি এবং অর্থনীতি নিবিড় সম্পর্ক রেখে চলে। আবার কোনো জাতি যখন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে থাকে তখন তাদের রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব পুরো বিশ্বের উপর বাড়তে থাকে। সভ্যতার সংকটের গতিপথ আমাদেরকে তাই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রেখে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি এবং বাণিজ্যনীতি ঠিক করতে হবে। না হলে সামনে আমাদেরও বিপদ আসতে পারে। কারণ পৃথিবী এখন কঠিন রিকন্সিলিয়েশনের দিকে যাচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট