মে দিবসেই কি থেমে থাকবে সবকিছু!
অজয় দাশগুপ্ত
ভালো-মন্দ মিশিয়েই সমাজ। দুনিয়ার সব দেশে এটা সত্য। কিন্তু আমাদের বেলায় বোঝা মুশকিলÑ কোনটা সত্য আর আর কোনটা মিথ্যা। এখন সামাজিক মিডিয়ার যুগ। ইউটিউব থেকে ফেসবুক সরকারবিরোধীদের জয়জয়াকার। মানুষের মনে রাগ বা দুঃখ থাকাটা স্বাভাবিক। এতে কোনো অন্যায় দেখি না। অন্যায় দেখি বিদেশে বাংলাদেশের অপমানে। আজকাল দেশের মানুষ যতটা রাজনীতিমুখি তার ঢের বেশি আগ্রহী প্রবাসে। আমি নিজেও একজন প্রবাসী। দিনরাত শ্রমের সমাজে বসবাস আমাদের। পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে শ্রমের কোনো বিকল্প নাই। মানুষ খেটে খায়। আমাদের দেশেও তাই। তবে পার্থক্য হচ্ছে দেশের জনগোষ্ঠীর একাংশ কোনো কাজ ছাড়াই ভালো থাকে। এই একাংশ এখন বেশ বড়।
অথচ আমাদের দেশে সাড়ম্বরে পালিত হয় মে দিবস। সেদিন সরকারি ছুটিও দেওয়া হয়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে পালনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রস্তাবনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। পরে ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী মে মাসের প্রথম দিন মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংঘের প্রতি আহŸান জানানো হয়। এ আহŸানের সাড়া হিসেবে বিশ্বের প্রায় সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশের শ্রমিকেরা মে মাসের ১ তারিখ সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানান। বিভিন্ন দেশে মে দিবস সরকারিভাবে ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ দিনটির তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি।
আমি যে দেশে বসবাস করি অস্ট্রেলিয়ায় এ দিন সরকারি ছুটি দেওয়া হয় না। কাল ভোরেই কাজে ছুটবো আমরা। কিন্তু এদেশে কোনো গৃহকর্মী নাই। পরিচারক পরিচারিকা নাই। কাউকে ডেকে বলতে পারবেন না যে বুয়া এককাপ চা দিয়ে যাও। বাপের বয়সী কাউকে দিয়ে জুতা পরিষ্কার করার দিবাস্বপ্ন দেখলেও বিপদ হতে পারে। শ্রমের মর্যাদায় এক নাম্বার দেশে মে দিবস নাই। আশ্চর্য না? হুম। এভাবেই গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্ব শ্রমের মর্যাদা পালন করলেও দিবস পালন করে না। হতে পারে এর কারণ রাশিয়া, চীনসহ সমাজতান্ত্রিক দেশে মে দিবস মহান দিবস। হতে পারে এই দিবস পালনে আছে সাম্যবাদের প্রভাব, তাই এরা দিবসটি মানে না। কিন্তু মানে শ্রমের মহান মর্যাদা ।
আমাদের সমাজে মে দিবস পালন আমার কাছে আড়ম্বর মাত্র। যেসব সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক নামের দল বা মানুষেরা এর কথা বলে গলা ফাটাতেন আজ তারা উধাও। তাদের জীবিত প্রজন্ম মজে আছে ভোগ বিলাসে। তাদের ঘর বাড়ি দারোয়ান পরিচারিকায় পরিপূর্ণ। তাদের ড্রাইভার তাদের আয়ারা জানেন বিশ্বে মহান মানুষ বলে কিছু থাকলেও বঙ্গদেশে নাই।
অথচ মে দিবসে সকাল বেলা খবরের কাগজ ডিজিটাল মিডিয়ায় ছবি খবর আর অনুষ্ঠানে মে দিবস আসবে। মনে হবে কী দারুণ মর্মার্থ চলছে বুঝতে পারছে সমাজ। যদি তাই হতো, রানাপ্লাজার ঘটনার সুরাহা সমাধান মিলতো। একের পর এক দুর্ঘটনায় গার্মেন্টস শ্রমিকেরা প্রাণ হারাতেন না। বারবার আগুনের দুর্ঘটনায় জানমাল হারিয়ে নিঃস্ব হতেন না বাজারের দোকানদারেরা। মে দিবস আর কতদিন খালি একটা দিবস থাকবে? এর উত্তর কেউই জানেন না। শুধু এটুকু বিশ্বাস করি, একদিন হয়তো মে দিবসের দিবস পালন লাগবে না থাকবে শ্রম আর শ্রমিকের মর্যাদা। লেখক ও কলামিস্ট