ফিনল্যান্ড কেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ?
শারফিন শাহ
জাতিসংঘের সুখী দেশের সূচকে টানা ছয়বারের মতো শীর্ষস্থান দখল করেছে ফিনল্যান্ড। এত এত ক্ষমতাধর, উন্নত দেশ টপকে কীভাবে ফিনল্যান্ড বারবার সুখী দেশের মুকুট ছিনিয়ে নেয়? কী রহস্য রয়েছে এর পেছনে? ইকোনোমিস্ট সাময়িকী বলছে, ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে সুখী দেশ হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এসব কারণ নিয়ে লুকোছাপার কিছু নেই। এগুলো সবার জন্যেই মৌলিক ও অপরিহার্য। কারণগুলো হচ্ছে: [১] শিক্ষা ব্যবস্থা: ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সাত বছর বয়স থেকে একটি শিশুর স্কুলজীবন শুরু হয় এবং তা চলে টানা ১৬ বছর পর্যন্ত। এ সময় শিশুদের কোনো পরীক্ষা বা হোমওয়ার্ক করতে হয় না। এই দীর্ঘ সময় শিশুরা সামাজিকতা, সহনশীলতা, সৃজনশীলতা, মানসিক বিকাশ ও প্রাকৃতিক জ্ঞানের দিকে মনোনিবেশ করে।
স্কুলে শিশুদের বিশেষ যত্ম নেওয়া হয়। গরিব, ধনী বলে কোনো তারতম্য নেই। সবাই দুপুরে উন্নত মানের খাবার ফ্রি পায়। এছাড়াও ফিনল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোরকম টিউশন ফি রাখেনি। অন্তত দশটি বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক রেংকিংয়ে ২০০ এর মধ্যে রয়েছে। [২] মনোরম প্রকৃতি: ফিনল্যান্ডের শহরগুলো গোছানো, ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। গাছগাছালি, বনানী, স্বচ্ছ পানির জলাধার দেশটিকে অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভ‚মি করে তুলেছে। সারা দেশে লেকের সংখ্যা ১ লাখ ১৮০ হাজার। কোথাও এতটুকু ময়লা নেই। আন্তর্জাতিক মানদÐে যেখানে একটি দেশের ২৫ শতাংশ বনভ‚মি থাকা দরকার, সেখানে ফিনল্যান্ডের রয়েছে শতকরা ৭৮ ভাগ।
[৩] স¤প্রীতি: ফিনল্যান্ডে শতকরা ২৮ শতাংশ মানুষ কোনো ধর্ম পালন করেন না। বাকিরাও ধর্ম সম্পর্কে খুব একটা মনোযোগী নয়। ধর্মের জন্যে পরস্পরের মধ্যে ব্যবধান ও কোন্দল এখানে ভাবাই যায় না। ধর্ম এখানে সংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া আর কিছু নয়।
[৪] স্বাস্থ্য: ফিনল্যান্ডে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে সবার জন্য সমানভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। [৫] রাজনীতি: ফিনল্যান্ডে রাজনৈতিক হানাহানি নেই। এখানে অধিকাংশ নেতাকর্মী তরুণ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সানা মারিনের বয়স মাত্র ৩৭। [৬] উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীনতা: ফিনল্যান্ডের জনগণের মধ্যে জীবন নিয়ে কোনোরূপ উচ্চাশা নেই। তারা মনে করে জীবন যন্ত্র নয়, জীবনকে ঘিরে উচ্চাশা করলেই বরং জটলা সৃষ্টি হয়। সুখী হওয়ার প্রথম ধাপ নিজের প্রত্যাশার মধ্যে অটুট থাকা। বাইরের চাপ এড়িয়ে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্ত রাখা।
[৭] বিনয়: বিনীত হও, বন্ধু, স্বজন, আপনজনদের সঙ্গে সবিনয় আচরণ করও। অভিযোগপ্রবণ হইও না। সংকটময় মুহূর্তে তাদের পাশে থাকো এই হচ্ছে ফিনিশদের বিনয়ের রীতি। [৮] আর্থিক সমতা: ফিনল্যান্ডে বেকার নেই, বেকারদের পর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান ও কাজের ব্যবস্থা সরকারই করে থাকে। এছাড়াও বড়লোক, গরিবের ব্যবধানও ফিনল্যান্ডে নেই। দুর্নীতি করে অবৈধভাবে আর্থিক উন্নতি এখানে অসম্ভব। [৯] নিরাপত্তা: খুনোখুনি তো নয়ই, সামান্য ঝগড়াঝাটিও নেই ফিনল্যান্ডে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনগুলো এখানে সবচেয়ে সুদৃঢ়। চুরি, ডাকাতিও এখানে রূপকথার গল্পের মতো। [১০] সুখের প্রদর্শন না করা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো নয়ই, পরিচিত মহলেও ফিনিশরা সুখের প্রচার করে না, সাফল্য, অর্জন নিয়ে হুল্লোড় করে না। [১১] বইপড়া: বইপড়া ফিনল্যান্ডের জীবনযাত্রার অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দেশটিতে ১৮০০০ এর মতো লাইব্রেরি রয়েছে। হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী এলান স্টার্ন ফিনল্যান্ডের সুখী হওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি কারণ খোঁজে পেয়েছেন। [১] নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া, [২] সেই বোঝাপড়ায় সামাজিক চাপ না টানা এবং [৩] স্বাভাবিক ও সহজাত প্রক্রিয়ায় জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর সঙ্গে সুসামঞ্জস্য ধরে রাখা।
স্টার্ন বলেন, আপনি সুখী হবেন কিনা তা আপনার উপরই নির্ভর করে, দিনশেষে আপনার গায়ের জামাটা আপনাকেই খুলতে হয়, অথবা আপনার একান্ত কেউ খুলে দেয়, আপনি এবং সেই মানুষটাকে ঘিরেই আপনার সুখের ভুবন। বাকীরা শুধু সুখের সাঙ্গী। ফিনিশরা নিজের সুখের ভুবনকে বাইরের সুখের ভুবনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে না বলেই তারা এত সুখী। সূত্র: ইকোনোমিস্ট, রিডার্স ডাইজেস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমস।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক