‘ধনী’, ‘জ্ঞানী-গুণীদেরও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু
বিপ্লব পাল
গত দু’সপ্তাহ ধরে কাশিটা কিছুতেই যাচ্ছে না। এন্টিবায়োটিক, গলার ওষুধ, এলার্জির ট্যাবলেট কিছুতেই সে যাবে না। এদিকে সব ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া কালচার করে কিছু পাওয়া গেলো না। এতেব বসে বসে কাশিটা সহ্য করা ছাড়া উপায় দেখছি না। আর এই এপ্রিল মাসে সকালে কখনো শূন্যের কাছাকাছি, কখনো দুপুরে ত্রিশ ডিগ্রি পৌছে যাচ্ছে। এমন বিটেকেলে ওয়েদার আর বাসন্তিক পোলেন মিলে, বেশ খেলা খেলছে। এদিকে আমেরিকা থেকে আসার পর, প্রথমে বাবা, তারপরে মা হাসপাতালে। যদিও তাদের হাসপাতাল যাত্রা এখন প্রায় রুটিন, তবুও না সারা পর্যন্ত, বাড়িতে না ফিরে আসা পর্যন্ত দুশ্চিন্তা থাকেই। সব মিলিয়ে সময়টা বেশ খারাপ যাচ্ছে।
আমি ভালো-খারাপ সময়ে বিশ্বাসী না। কিন্তু একটা কথা ঠিক, শরীর সুস্থ না থাকলে, সেটা ডেফিনিটলি ‘খারাপ’ সময়। গত ত্রিশ বছরে এতো দীর্ঘদিন ধরে ভুগেছি বলে মনে নেই। যাইহোক আমার খারাপ সময়ের সঙ্গী উপনিষদের গল্প। আর ফিজিক্সের লেটেস্ট ডেভেলেপমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা। এটা দীর্ঘদিনের অভ্যাস। উপনিষদের গল্পে প্রতিবাদ নেই, আশা আছে, মানুষ নিজের জীবনকে একটু অন্যভাবে দেখবে। যাতে তার বৃহত্তর উপলদ্ধি হয়। প্রতিবারই যখন উপনিষদের গল্পগুলো শুনি-কিছু না কিছু নতুন চিন্তার খোরাক পেয়েই থাকি। এবারও পেলাম। ভাবলাম সেটাই শেয়ার করি।
বেসিক্যালি আমাদের সব রাজনৈতিক/দৈনন্দিন চিন্তাকে তিন ভাবে আমি ভাগ করি। একটা চিন্তার ধারা এই যে যে আমরা বঞ্চিত/নির্যাতিত-জাস্টিস চাইছি। ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো কমিউনিজম, খ্রিস্টানিটি, ইসলাম থেকে অনেক জাতিয়তাবাদি পার্টির চিন্তার ভ‚মি। আবার অনেকেই পারিবারিক, সাংসারিক, চাকরি ক্ষেত্রেও অখুশি। বঞ্চনা। যেমন যেকোনো স্বামী স্ত্রীকে প্রশ্ন করুন। প্রায় প্রত্যেকেই মনে করে তাদের বেটার হাফ-তাদের বিবাহিত জীবনের প্রতি জাস্টিস করেনি। মেয়েদের মনের মধ্যে বঞ্চনার সুর আরও চড়া। ভুল বিয়ের জন্য জীবন রসাতলে। বেসিক্যালি সংসারে আমি খেটে বলদ হলাম, কিন্তু বিনিময়ে কী পেলাম? এই চিন্তা সবার মধ্যেই আসে। কিন্তু যাদের মধ্যে এটা বেশি ঘোরে-যারা এটাকে বেশি পাত্তা দেয়, তারা হয় রাজনীতিতে যায়, নইলে র্যাডিক্যাল হয়। খুব যে মানসিক শান্তিপূর্ণ জীবন পায় না, তা বলাই বাহুল্য। এখানে বলা ভালো-বঞ্চিত, প্রতারিত আমরা সবাই। কিন্তু ওই চিন্তাটাই যদি মাথায় সব সময় চেপে বসে, এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
আরেক ধরনের চিন্তা আমরা বহন করি কাজ করার সময়। তখন মাথায় রাখতে হয় কাজটা যেন নামে, মোদি, মমতা, নেতাজি, পেঁইয়াজি, কে কী করেছে ভেবে লাভ নেই। ঘোড়ার চোখ-কাজটা নামাতে হবে। সেটা অফিসের চাপ, বৌ/সংসারের চাপ-অনেক কিছুর চাপেই হতে পারে। তখন বঞ্চনা, জাস্টিস ভুলে কাজটা নামাতে হয়। এটা প্রোডাক্টিভ মাইন্ড। এর বাইরে আরো একটা শেড আছে। যে চিন্তাটা ভারতীয় দর্শন দিয়েছে। দেখবেন আপনার আশেপাশে যদি বৈষ্ণব, প্রকৃত বৈষ্ণব থাকে-তারা প্রতিদিনের আপ-ডাউন সুঃখ-দুঃখ নিয়ে চিন্তিত না। তারা তাদের রাঁধা ভাবেই বিভোর। বৌদ্ধরাও নিজেদের সাধনার জগতে থাকে। ইহজগতের জাস্টিস, বঞ্চনা, দুঃখ-তাদের ও নাড়া দেয় না। প্রাচ্য দর্শনের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। ভারতের প্রাচীন ঋষিরা এটাই বলছেন, এই যে পাওনি, বঞ্চিত, নির্যাতিত, এসব চিন্তায় ডুবে আছ, এই তুমিটাই বা কে? আর তুমি’ কি পাওনি? আর সেটাই যখন জান না কীসের জন্যই বা দুঃখ করছো?
উপনিষদের প্রায় সব গল্পের পরিণতি একটাই, যাতে মানুষ বোঝে তাদের দেহ এবং মনের উপারেও তাদের ‘অপরিবর্তনিয়’ এক্সিস্টেন্স আছে। এই হাইপোথিসকে তারা আত্মা, পরমাত্মা ইত্যাদি নাম দিয়েছে। হাইপোথিসিস ঠিক না ভুল-সেসব ভেবে লাভ নেই। লাভ এখানেই যে মানুষের সব চিন্তা চাহিদা দেহের কামনা বাসনাই আটকে থাকলে, এমন একটা লোভী পৃথিবীর মধ্যে আমরা সবাই আটকে যাবো, সেখানে কেউ থাকতেই পারবে না। ভারতের শহরগুলোতে পা ফেলা মাত্র আমার সেটাই মনে হয়, সেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে, হোটেলিয়ার, রেস্টুরেন্ট থেকে হাসপাতাল, হ্যান্ডিম্যান-সবাই মনে হয় পকেট মারার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে ব্যতিক্রমও আছে। যারা নিজেদের কাজকে সার্ভিস হিসেবে নিয়েছে। অভিয়াসলি সেসব জায়গায় সার্ভিস পেতেও ভালো লাগে। ভারতীয় দর্শন ঠিক এখানেই মনের পরিবর্তন আনে। যে কাজটা আমরা করছি-তা আমাদের দেহের কামনা বাসনা থেকে উদ্ভত-নাকি অন্যদের সেবা করার জন্য নিবেদিত? সম্পূর্ণ লোভের দ্বারা কোনো সিস্টেম চলতে পারে না। অথচ পাশ্চাত্যের ধণতন্ত্রে আমরা সেটাই করার চেষ্টা করি। যা গণিতের নিয়মেই সাসটেনেবল না।
যাইহোক ছান্দগ্যো উপনিষদের গল্পে ফিরে আসি। এই গল্পের হিরো ঋষি ঋকভ। রাজা জনশ্রæতি, রাজা জনকের ন্যায় জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি জ্ঞানী, দানী এবং সার্থক পুরুষ। একদিন রাজা ছাদে বসে আছেন। হঠাৎ দুই পাখির মধ্যে ঝগড়া শুনলেন। একটি পাখি বলছে, দেখেছ রাজা কি বিরাট জ্ঞানী এবং সার্থক পুরুষ। অন্য পাখি বললে, তাতে কী? রাজার জ্ঞান এবং বুদ্ধি, মোটেই ঋষি ঋকভের সমতুল্য না। রাজা জনশ্রæতি ভাবলেন ব্যাপারটা কী? ঋষি ঋকভ আমার থেকেও একজন জ্ঞানী পুরুষ, আর আমি তার কথা জানিই না? তিনি তার দলবলকে বললেন খুঁজে বার কর ঋষি ঋকভকে। নগরে, গ্রামে তল্লাশি চললো। রাজার লোকেরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। রাজা এবং তার পরিশদেরা যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন, এমন সময় খবর এলো এক গাড়োয়ান নাকি ঋষি ঋকভকে চেনেন।
রাজা দলবল সমেত সেখানে হাজির। এক গাড়োয়ান, যাকে শুদ্র বলেই মনে হয়, সে গাড়িটা রেখে রোদ পোহাচ্ছে। রাজা বললেন, আপনি ঋষি ঋকভকে চেনেন? গাড়োয়ান বললেন আমিই ঋষি ঋকভ। রাজা সঙ্গে প্রচুর সোনাদানা গিফট হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো দিয়ে বললেন, আপনার কাছে শিখতে এসেছি। শুনেছি আপনি পরম জ্ঞানী। ঋকভ কোনো উপহার নিলেন না। রাজাকে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন ভাই রোদ পোহাচ্ছি, রোদটাকে আটকিও না। আর কিছু তোমার কাছ থেকে চাইছি না রাজন। দয়া করে রোদ আটকিও না। রাজা পরের দিন আবার এলেন। এবার একা। এবার ঋষির পায়ের কাছে গিয়ে বসলেন। এবার ঋষি রাজা জনশ্রæতিতে যে জ্ঞান দেবেন তা ছান্দোগ্য উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়। আমি সেই জ্ঞানের মধ্যে যাচ্ছি না।
গোটা গল্পের একটা মূল সুর আছে। আপনি যেকোনো পেশাতেই থাকুন না কেন, সঠিক জ্ঞানঅর্জনে বাধা নেই। আর আপনি যতোই ধনী এবং জ্ঞানী হোন না কেনÑসব সময়েই সাধারণ লোকেদের কাছ থেকে আপনার অনেক কিছু শেখার থাকবেই। জ্ঞান এবং ধন-দুটোই মানুষকে অন্ধ করে। আমাদের আশেপাশের জ্ঞানী এবং ধনীদের মধ্যে অন্ধের সংখ্যা বেশ বেশি। ফেসবুক থেকে