ভারতের লাইন অফ ক্রেডিটের সঠিক ব্যবহার কি করতে পারছে বাংলাদেশ
কাজী এম মুর্শেদ
ভারত বিভিন্ন দেশকে লাইন অফ ক্রেডিট দেয়। হিসাব দেখছিলাম, ২০১৭ থেকে ৬৫টি দেশে ৩১ বিলিয়নের বেশি লাইন অফ ক্রেডিট দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৫ বিলিয়ন পেয়েছে। বৈদেশিক ঋণ আর লাইন অফ ক্রেডিট এক না। এটা অনেকটা বাজেট বরাদ্দ করা, প্রজেক্ট ও শর্ত অনুযায়ী কাজ হলে টাকা ছাড় দেবে। তবে শর্ত হিসাবে খাতের কথা বলা থাকলেও ঋণের শর্ত একদম খারাপ না। টাকা ছাড় হলে ২০ বছর মেয়াদি ঋণ, যার সুদ ১% করে, আর গ্রেস পিরিয়ড ৫ বছর। তবে আছে, কোন খাতে খরচ করা যাবে, তা ভারতের হিসাবের মধ্যে থাকতে হবে এবং ৬৫-৭৫% পণ্য ও সেবা ভারত থেকে আসতে হবে।
প্রথম দফায় ২০১০ সালে ৮৬২ মিলিয়ন ডলার লাইন অফ ক্রেডিট দেয়, এর কোনো খরচই বাংলাদেশ করতে পারেনি। দ্বিতীয় দফায় ৩.০৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৫৭৬ মিলিয়ন খরচ করতে পেরেছে। তৃতীয় দফায় ৪.৫ বিলিয়ন বিদ্যুৎ, রেলরোড রাস্তা, শিপিং, বন্দর এসব খাতে দেওয়া হয়। বাকি ৫০০ মিলিয়ন যোগাযোগ ব্যবস্থায়।
আবারো মনে করায় দিই, লাইন অফ ক্রেডিট অনেকটা সমঝোতা স্মারকের মতো, টাকাপয়সার লেনদেন হয় না। আর ঋণ হলো চুক্তির মতো, উদ্দেশ্য, অর্থ খরচ এবং সময়সীমা থাকে। তৃতীয় লাইন অফ ক্রেডিটের কতো খরচ হয়েছে হিসাব পাচ্ছি না, তবে দুই বিলিয়নের মতো প্রজেক্ট তৈরি করতে পেরেছে, ঋণ নিয়েছে কিনা কোনো সোর্স পাচ্ছি না। আমার জানামতে, রেললাইন করে ভারত থেকে বিভিন্ন সংযোগ ছিলো, যেমন কলকাতা থেকে খুলনা হয়ে রামপাল। আবার বাগডোগরা থেকে সৈয়দপুর। ৪০০০ বাস কেনার কথা ছিলো। রূপপুরে রাশিয়ার সঙ্গে কাজের সহায়তায় ছিলো, রামপাল ছিলো, পায়রা থেকে আমিনবাজার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ছিলো।
তবে যেটা সবচেয়ে ইনটারেস্টিং, কলকাতা থেকে ত্রিপুরা যেতে ২৬০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতো, এখন বাংলাদেশের ভেতরে রাস্তা উন্নয়নে সেই টাকা খরচ হয়েছে, যেই রাস্তা ২১০০ কিলোমিটার কমিয়ে এনেছে। তার জন্য নামমাত্র শুল্ক দিতে হয়, পুরো সুবিধা ভারত পাচ্ছে, একইসঙ্গে টাকা তাদের বলে ঋণ হিসাবে ধরে বাংলাদেশকে সুদসহ ফেরত দিতে হবে। দুইভাবে বা তিনভাবে লাভ। আরো কিছু রেলপথ ছিলো, যা ঢাকা-কলকাতা ও ঢাকা-আসাম সংযোগ করবে, মূলত কলকাতা-আসাম সংযোগ। আবার রেলের বগি আর ইঞ্জিনও ছিলো।
যেহেতু লাইন অফ ক্রেডিট, ভারতের শর্ত মানতে হবে, প্রজেক্ট তাদের মতে হতে হবে। আবার কিছু ব্যাপার আছে বেশ ভালো, যেমন চট্টগ্রাম ও মোংলা পোর্ট নামমাত্র খরচে ব্যবহার, নদীপথে বাণিজ্যে কোনো খরচ নেই, রাস্তা ব্যবহারে সামান্য খরচ, সরকার সবসময় দিল্লি মুখাপেক্ষি, নদীর পানি আটকে বাঁধ দিলে কিছু বলে না, বিদ্যুৎ চুক্তি করে দেড় থেকে দুইগুণ দামে বিক্রি, যেকোনো ল্যান্ডপোর্ট ব্যবহার, ফেনী নদীতে বন্ধুত্ব সেতু করে চট্টগ্রাম থেকে মাল ছাড়িয়ে আসাম, ত্রিপুরায় পাঠানো, তেল অনুসন্ধানের সম্ভাব্য চুক্তি, বর্ডারে মানুষ খুন করলেও কোনো জবাবদিহিতা নেই! নেপাল-ভ‚টানের সঙ্গে ট্রানজিট না দিলেও কিছু আসে যায় না, পাট কিনলে প্রতি টনে ৩৫২ ডলার এন্টি ডাম্পিং ডিউটি, জলপাইগুড়ি সৈয়দপুর তেলের পাইপ লাইন তৈরি করে তেল রপ্তানি, যার ১৩০ কিলোমিটার পাইপ লাইনের খরচ ঋণের মধ্যে। লিস্ট বলে শেষ করার মতো না। এখনো হেল্থ টুরিজম বলি নেই, চাকরি করতে আসলে যে সুযোগ পায়, ভিসা নিয়ে এসে চাকরি করা, বিশাল রেমিটেন্স আহরণ, দেশের বড় কিছু ফ্যাক্টরি বন্ধ করে ভারত থেকে আনা, টাকা পাঠাতে হুন্ডির কারবার, সোনা চোরাচালানে বাংলাদেশ পোর্ট ব্যবহার, ঈদের শপিং, লিস্ট অনেক লম্বা। মাঝে মাঝে মনে হয়, ভারতে জন্মায় ইন্ডিয়া এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যাংকে বা হাইকমিশনে চাকরি পেয়ে ঢাকায় পোস্টিং পাবার চেয়ে আরামের জীবন মানুষের খুব কম কাছে। লেখক : অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষক