পণ্য হাতে পাওয়ার আগেই অন্যত্র বিক্রি করা যাবে কি, শরীয়ত কী বলে?
জিল্লুর রহমান
ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে আমার খুব একটা পড়াশোনা নেই, খুব বেশি প্রয়োজনও মনে করি না। শুধু ব্যক্তিগত আমলের জন্য যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু জানার চেষ্টা করি। যেহেতু মাঝেমধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য করার চেষ্টা করি, তাই কিছুটা জানার ইচ্ছে। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ব্যবসার শরীয়ত না জেনে ব্যবসা করলে সেখানে সুদের আশঙ্কা থাকে। ইসলাম সুদ হারাম এবং ক্রয় বিক্রয়কে বৈধ করেছে, অর্থাৎ এটি নিঃসন্দেহে বৈধ পন্থা।
আজকে মালামাল বিক্রয়ের বিষয়টি সবার সঙ্গে একটু শেয়ার করছি। পণ্য হাতে পাওয়ার আগেই অন্যত্র বিক্রি করা যাবে কি, শরীয়া কী বলে? কোনো কোনো ব্যবসায়ী আছেন, যাদের কাছে পণ্য মজুত থাকে না, তারা নিজেদের কাছে পণ্যের নমুনা রাখেন মাত্র। গ্রাহককে নমুনা দেখিয়ে ক্রয়-বিক্রয় করেন। পারস্পরিক ক্রয়-বিক্রয় করার পর ক্রেতার কাছ থেকে মূল্য নিয়ে অন্য আড়তদার থেকে পণ্য ক্রয় করে ক্রেতাকে সরবরাহ করেন। অথবা একজন আমদানিকারক, যিনি বিদেশ থেকে বিভিন্ন মালামাল আমদানি করেন। বিভিন্ন বিদেশি পণ্যের নমুনা এনে দেশীয় কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন। এক্ষেত্রে তিনি শুধু নমুনা দেখিয়ে দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে মূল্যনির্ধারণপূর্বক বেচাকেনা সম্পন্ন করেন এবং অগ্রিম টাকাও নিয়ে নেন। এরপর বিদেশি বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করেন।
বিদেশি বিক্রেতার কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করে দেশীয় কোম্পানিকে হস্তান্তর করেন। এ ধরনের নানা ব্যবসায়িক পদ্ধতি আমাদের দেশে প্রচলিত রয়েছে। জানার বিষয় হলো, এভাবে নমুনা দেখিয়ে অগ্রিম পণ্য বিক্রি করা জায়েজ হবে কি না। এ ধরনের ব্যবসা জায়েজ নয়। কেননা এ জাতীয় ব্যবসায় যে পণ্যটি বিক্রেতার মালিকানায় নেই সেরকম একটি পণ্যকে বিক্রি করা হয়। আর কোনো পণ্যকে নিজের মালিকানায় হস্তগত করার আগে ওই পণ্য বিক্রি করা জায়েজ নেই।
যদিও এ বিষয়ে মাজহাবের ইমামদের মাঝে কিছুটা মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। যেমন, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) এর কাছে পণ্য খাদ্যদ্রব্য হোক বা অন্য বস্তু হোক, স্থাবর হোক বা অস্থাবর, হস্তগত করার আগে তা বিক্রি করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম ১-৩৩৮,আলমুগনী ৪-১১৩।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, অস্থাবর জিনিস, চাই তা খাদ্যদ্রব্য হোক বা অন্যকিছু, হস্তগত করার আগে বিক্রি করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। তবে স্থাবর জিনিস হস্তগত করার আগে বিক্রি করা জায়েজ। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন, শুধু খাদ্যদ্রব্য হস্তগত করার আগে বিক্রি করা নাজায়েজ। ইমাম মালেক (রহ.) খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে ওজন-পরিমাপিত ও পরিমাণ-পরিমাপিত বস্তু হস্তগত করার আগে বিক্রি করা নাজায়েজ।
এ মতবিরোধের মূল কারণ হলো, হস্তগত করার আগে কোনো জিনিস বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত হাদিসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত পেশ করেছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, যেহেতু হাদিসে খাদ্যদ্রব্যের কথা উল্লেখ রয়েছে, কাজেই খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গেই নিষেধাজ্ঞা নির্দিষ্ট। খাদ্যদ্রব্যের বাইরে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। সুতরাং খাদ্যদ্রব্য ছাড়া বাকি জিনিস হস্তগত করার আগে বিক্রি করা বৈধ। ইমাম মালেক (রহ.) এর ব্যাখ্যা হলো, হাদিসে খাদ্যদ্রব্যে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, কেননা তা ওজন-পরিমাপিত বা পরিমাণ-পরিমাপিত বস্তু। সুতরাং ওজন-পরিমাপিত ও পরিমাণ-পরিমাপিত জিনিস ছাড়া অন্য বস্তুর ক্ষেত্রে হস্তগত করার আগে বিক্রি জায়েজ হবে।
আসল ব্যাপার হলো, এখানে শরিয়তের বড় একটি মূলনীতি রয়েছে, কোনো জিনিস থেকে লাভবান হওয়ার জন্য ওই জিনিসটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মালিকানায় ও তার দায়িত্বে থাকতে হবে। দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া মুনাফা লাভ শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের ওইসব জিনিস বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন, যা আমাদের মালিকানায় বা জিম্মায় নেই। নিষেধাজ্ঞার কারণ ও মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যে জিনিস এখনও জিম্মায় বা দায়িত্বে আসেনি, তার উপর মুনাফা গ্রহণ করা বৈধ নয়।
এ মূলনীতির সারকথা হলো, মুনাফা তখনই গ্রহণ করা যাবে, যখন সে তার জিম্মাদারি নেবে। লাভ-লোকসানের ঝুঁকি নেবে। হস্তগত করার আগে বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ার মূল কারণ হলো, জিম্মাদারি বা দায়িত্ব গ্রহণের আগে বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়া। কারণ হস্তগত করার আগে কোনো জিনিসের ওপর জিম্মাদারি বা দায়িত্ব বর্তায় না। এটা শরিয়তের একটি বড় মূলনীতি। মোট কথা, নিজের মালিকানায় যে পণ্য এখনো আসেনি, শুধু নমুনা দেখিয়ে সে পণ্য বিক্রি করা জায়েজ নয়।
কেননা এ ব্যাপারে সরাসরি হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হাকিম ইবনে হিযাম (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল। আমি পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করি। এর কোন পন্থাটি হালাল, কোনটা হারাম? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন তুমি কোনো পণ্য ক্রয় করবে, তখন তা হস্তগত করার আগে অন্যত্র বিক্রি করবে না। – মুসনাদে আহমদ, ১৫৩১৬।
ওমর (রা.) বলেন, যখন তুমি কোনো বস্তুতে সালাম-চুক্তি করবে, তখন তা হস্তগত হওয়ার আগে অন্যত্র বিক্রি করবে না। -মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, ১১-৩২, মুসনাদে আহমদ, ৩- ৪০২। হেদায়া, ৩-৯৭। ফাতহুল কাদির, ৬-১৩৫, বাদায়েউস সানায়ে, ৪- ৩৯৭। আরেকটি হাদিসে এসেছে, আবুল ওয়ালিদ (রা.) ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘খাদ্য খরিদ করে কেউ যেন তা হস্তগত করার আগে বিক্রি না করে। – বোখারি, ৩৪৩।
অতএব মালিকানায় মাল বা পণ্য না থাকলে নমুনা দেখিয়ে বিক্রি করা জায়েজ হবে না। তবে জায়েজ হওয়ার বিকল্প একটি পদ্ধতি হতে পারে। তাহলো, যখন কেউ মালের অর্ডার নেবে, তখন ক্রয়-বিক্রয় চূড়ান্ত করবে না, বরং অ্যাগ্রিমেন্ট টু সেল বা ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতিশ্রæতি নেয়া যাবে মাত্র।
বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকিং এর অন্যতম একটি পদ্ধতি ধারে মাল বিক্রয়, এটি যায়েজ। কিন্তু মাল হস্তগত না হওয়া পর্যন্ত বিক্রয় নাযায়েজ, শরীয়া সমর্থন করে না। ব্যাংক মালামাল হস্তগত করে বিক্রি করে বলে জানা নেই। লেখক: সাংবাদিক