
অকটেনের দাম, ইসলামী ব্যাংক এবং আসামের ১৯ লাখ মানুষ

কাজী এম মুর্শেদ
[১] অকটেনের দাম ছিলো ৮৯ টাকা, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে দাম বাড়িয়ে করা হলো ১৩৫ টাকা, যদিও বিশ্ববাজারে তখন দাম পড়তির দিকে ছিলো। প্রতিমন্ত্রীর অকাট্য যুক্তি, তেল যেহেতু আগের দামে কেনা এবং আসছে সেজন্য আগের দাম পরিশোধ করতে হবে। শিঘ্রই পুনরায় সমন্বয় হবে। কয় মাস পর সমন্বয় হলো, ১৩৫ থেকে ১৩০ টাকা। আগেরবারের কথা মনে করায় দিই। অকটেন ছিলো ৬৭ টাকা, বেড়ে ৯৪ টাকা হয়েছিলো। তখন যুক্তি ছিলো পূর্বের ক্ষতি সমন্বয় করার জন্য দাম কমানো যাবে না, তবে বিবেচনা করা হবে। সেটা ৫ টাকা কমে ৮৯ টাকা হয়েছিলো।
আমাদের রাজনীতিবিদদের সব ধরনের যুক্তি আছে। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের তেল আসছে না, বিশ্ববাজারে দাম বাড়া, দাম কমলে তখন কেন যেন সমন্বয় হয় না, সাংবাদিক বা জনগণের প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া। সবশেষ যে কাজটা করলেন, বিদ্যুৎ বা জ্বালানির দাম নির্ধারণ করতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিটিতে যেই গণশুনানি হতো, যার ওপর নির্ভর করে দাম সমন্বয় হতো, সেই কমিশনের ক্ষমতা মন্ত্রিসভায় নিয়ে গেলো। এখন জনগণের কথা বলার কিছু নেই, সোমবার মন্ত্রী পরিষদের মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আমি তেল নিয়ে তেমন মাথা ঘামাই না, বিশ্ববাজারে দাম কমেছে দেখলাম। যা জানি না, যেমন শেয়ারবাজার, তেলের বাজার, সোনা-রূপার বাজারÑ এসব নিয়ে লেখা হয় না। আজ লিখছি বিশেষ কারণে। [১] বিশ্ব তেলের বাজারে দাম কমেছে। [২] মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিন দেশ সফর করে ফিরবেন। [৩] ফেরার পর গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন। [৪] এখানে পছন্দের সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মিলন মেলা বসে। [৫] একটা দিন কয়েক ঘণ্টা তেলের বন্যা বয়ে যায়। এই তেল অত্যন্ত উন্নতমানের। এই তেলে গাড়ি চলে না, রান্নার ব্যবহার হয় না, গা মালিশে ব্যবহার হয় না, আবার ভাপ ওঠা ভাতের সঙ্গে খাওয়া যায় না। তেলটার একটাই খারাপ গুণ, সময়মতো না দিতে পারলে এটা নষ্ট হয়, এজন্য বাঁচানোর জন্য নিজের মাথায় দিতে হয়। প্রায় সকল পুরুষ সাংবাদিকের মাথার চুলের অবস্থা প্রায় এক।
[২] প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনের নিউজ, ‘ইসলামী ব্যাংক থেকে এক বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন আমানতকারীরা’। আমানত (ডিপোজিট) কমলেও ঋণ বিতরণ (ল্যান্ডিং বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকার। মোট আমানত ঋণ রেশিও ১.০০ : ০.৯২Ñ এটা খুবই ভালো রেশিও। তবে অনেক ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা হয়তো ফিরবে না, সেই হিসাবে আমানত তুলে নিয়েছে অনেকে। গ্রস মুনাফা ৬১৬ কোটি, নীট মুনাফা ৪৮০ কোটি। এতো সমস্যা, নিউজ কাভারেজের পরও এটা বেশ ভালো বলতে হবে। বিশেষ করে ভয়ঙ্কর নভেম্বর, ঋণ জালিয়াতির খবরে আমানত তুলে নেওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নগদ লোন নেওয়া, তারপরও ব্যাংক ভালো করেছে। আগে থেকে বলছিলাম, ব্যাংকের টাকা তুলে ঘরে আটকায় রাখবেন না, লিকুইডিটি ক্রাইসিসে আমেরিকায় তিনটা ব্যাংক বন্ধ হয়েছে। অনেকে শুনেছে, অনেকে শোনেননি। যারা শোনেননি, ব্যাংক আরও ভালো করতে পারতো।
তারপরও কিন্তু থাকে। ইসলামী ব্যাংক একটা ব্যাংক, একই মালিকানায় আরও ৫ টা ব্যাংক আছে। বড়টা টিকে গেছে, বাকিগুলোর রিপোর্টে বোঝা যাবে। সোশাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গেøাবাল ইসলামী ব্যাংকÑ তাদের অডিটেড রিপোর্ট দেখলে পুরো চিত্র বোঝা যাবে। ব্যাংকে আপনার টাকা সুস্থ থাকবে, টাকা তুলে বাসায় রেখে লিকুইডিটি ক্রাইসিস করেন না। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক আগের মতো নেই, মুদ্রানীতি ঘোষণা হচ্ছে, নিয়ম-কানুন মানছে। কোনো ব্যাংক বন্ধ হবার ভয় নেই। একটাই দুঃখ, এই রেগুলেটরি বডি কথা শুনেও কাজ করে। তবে বাদামি চামড়ার এদের এলার্জি আছে, সাদা চামড়ার আইএমএফ হলে ঠিকই শোনে এবং মানে।
[৩] আমার জিনিসপত্র কিনতে দর-দাম করতে ইচ্ছা হয় না। যদি ফিক্সড প্রাইস স্টোরে যাই, যদি কিছু পছন্দ হয় এবং বাজেটের মধ্যে হয়, নিই। না হলে দোকানে গেলেই কিছু কিনতে হবে সেই নিয়ম মানি না। অন্যসব দোকান দুই রকম, দরা-দরির স্কোপ থাকলেও করি না, ছোট জিনিসে সামান্য লাভ থাকে, দাম কমালে লাভ চলে যায়। এজন্য রাস্তায় বই যারা বিক্রি করেন, দাম জানি বলে দরাদরি করি না, একবারে নিয়ে নিই। আরেক রকম আছে, দরাদরি করতে হয়, সেখানেও ভালো লাগে না, হয় জিজ্ঞাস করি একবারে দাম বলেন, নেবো বা নেবো না, অথবা দাম জিজ্ঞাস না করে আমিই বলি কতো দেবো। দিলে দেবে না দিলে নেই। কিন্তু চলে যাবার পর পেছন থেকে ডেকে এখনো কেউ কিছু গছাতে পারেনি। থামি না, শুনি না। কয়েকদিন আগে এক দোকানে এক কাজে গেছি, বললাম কত হয়েছে, বললো ৩৮০০ টাকা। বললাম, একটা শেষ দাম বলেন, যাতে নিতে পারি, বললো, আচ্ছাÑ আপনি ৩৭০০ টাকা দিয়েন। বললাম, ৩৭০০ দিতে পারলে ৩৮০০ দিতে পারবো, দাম কমানো লাগবে না, আমি নেবো।
আপনি চিন্তা করেন, একটা শার্ট কিনতে গেলেন, দাম ২৫০০ টাকা। আপনি বললেন, ৫০০ টাকায় দেবেন? দোকানির মায়া লাগলো, বললো যান ভাই ফ্রি নিয়ে যান, আপনি এতো গরিব, মায়া লাগলো বলে দিলাম। আপনি তখন পকেট থেকে ৫০ টাকা বের করে বললেন, এটা রাখেন, বাসায় গিয়ে বলি কীভাবে মাগনা খয়রাত দিয়েছে? বলবো দরাদরি করে সস্তায় পেয়েছি। এরজন্য না হয় আপনার হাত পা টিপে দিই যেন ৫০ টাকা খরচটাও যেন হালাল হয়। বাসায় পৌঁছে খুশি হয়ে স্ত্রীকে জানালেন, তিনি হেসে বললেন, তুমি আসলেই খয়রাতি। আপনার যে খুশি হবার কথা উল্টো আপনার রাগ বাড়লো, এই দোকানি আমাকে অপমান করেছে, আপনি ঠিক করলেন প্রতিশোধ নিতে হবে।
ভারতে এনআরসি বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন ব্যবস্থা আছে। আসামে ৩ কোটি ১০ লাখ লোককে নাগরিকত্ব দিলেও প্রায় ৪ বছর ধরে ১৯ লাখ লোক না ভারতের নাগরিক না অন্য কোথাকার। তাদের আইনগত অস্তিত্ব নেই বলে সরকারি সুযোগ পান না, অনেকে লুকিয়ে দিন কাটাচ্ছেন, তাদের হুমকি দেওয়া হয় তোমাদের বাংলাদেশে পাঠানো হবে। কারণ তোমরা ভারতের নাগরিক না। আমরা সেই শার্ট বিক্রেতা, কম দামে শার্ট দিলাম, আবার ভিক্ষুক না তার জন্য কিছু টাকা রাখলাম। সেই ভিক্ষুক কীভাবে এই শার্ট বিক্রেতাকে জব্দ করবে সেই রাস্তা খুঁজে চলছে। কী দরকার ছিলো এতো সস্তায় শার্ট দেবার? পুরো ফ্রি দিলে সমস্যা হতো না বা সামান্য দাম কমালেও হতো। ভিক্ষুকের পর্যায়ে নামিয়ে দেবার জন্য এখন অপেক্ষা করেন হয় প্রতিবেশী কবে মাফ করে অথবা নাফ নদীর পানির মতো আরেক দফা শরণার্থী কবে নিতে হয়।
ইংরেজিতে কৃতজ্ঞ এবং অকৃতজ্ঞ শব্দের অর্থ হলো গ্রেটফুল এবং আনগ্রেটফুল। কিন্তু কৃতঘœ বা যে উপকারী অপকার করে তার কোনো ইংরেজি নেই। এই ৫০ টাকায় শার্ট কেনা ভদ্রলোক অনেকটা তেমনি। সিম্বলিক লেখার সঙ্গে কোনো বাস্তব অবস্থা মেলাতে যাবেন না। ঈষৎ পরিমার্জিত। লেখক: অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষক
