
দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ

শরিফুল হাসান
কথায় কথায় শুনবেন, বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হলো, আইসিইউ জীবাণুমুক্তকরণ এবং এসি যন্ত্রের কারিগরি সমস্যার কারণে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১১ দিন ধরে কার্ডিয়াক সার্জারি হচ্ছে না। সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত কোনো দেশ তো পরের কথা, সাধারণ কোনো দেশেও এমনটা ঘটবে কল্পনা করা কঠিন। অথচ সেটাই ঘটছে বাংলাদেশে। জানি না আপনারা আরেকটা খবর দেখেছেন কি না। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা এক তরুণ শাহীনকে বাঁচানোর আশা নিয়ে তাঁর স্বজনেরা মঙ্গলবার রাতে এসেছিলেন ঢাকায়। মুমূর্ষু শাহীনকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রাতভর তাঁরা ঘুরেছেন এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে। কিন্তু কোথাও তাঁকে ভর্তি করতে পারেননি। অবশেষে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন শাহীন।
এর আগে শাহীনকে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে ফেনী শহরের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য এই হাসপাতালের চিকিৎসা-সরঞ্জাম যথেষ্ট নয়। তাঁরা দ্রæত রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন। অক্সিজেন লাগিয়ে শাহীনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে তাঁকে ভর্তি করা যায়নি। কারণ, এই রোগীর জন্য যে আইসিইউ সুবিধা দরকার, সেই শয্যা চট্টগ্রাম মেডিকেলে ফাঁকা নেই।
মারাত্মক অসুস্থ বা জীবন বিপন্ন, এমন রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ শয্যার দরকার হয়। শুনলে অবাক হবেন, বাংলাদেশের ২২টি জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা নেই। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, শরীয়তপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও কুড়িগ্রাম, নাটোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, জামালপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, নেত্রকোনা, চুয়াডাঙ্গা, সুনামগঞ্জ, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও বরগুনা। এ ছাড়া বাগেরহাট ও মাদারীপুর জেলায় সরঞ্জাম থাকলেও আইসিইউ চালু নেই। ভাবুন একবার বাংলাদেশ এতো উন্নত হয়েছে, অথচ দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা নেই। কোভিড মহামারীর সময় শুনেছলিাম, সব জেলায় আইসিইউ হচ্ছে। জানি না সেই প্রকল্প কোথায় গেলো।
না আমাদের টাকার অভাব আছে তা কিন্তু নয়। স্বাস্থ্যখাতে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি আর লুটপাট নিয়মিত খবর। প্রথম আলোর আরেক খবর বলছে, কোটি কোটি টাকা দিয়ে বিভিন্ন জেলায় ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি ভবন করে ফেলা রাখা হয়েছে। একেকটি ভবন নির্মাণে গড় ব্যয় প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে ১৫টি ইনস্টিটিউট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকার মতো। কিন্তু এগুলোর অধিকাংশই অব্যবহৃত পড়ে আছে। আসলে আমাদের দেশে উন্নয়ন মানে কোটি কোটি টাকা দিয়ে ভবন নির্মাণ করা হবে। সেই ভবনে কোনো একজন মন্ত্রী বা এমপির নামে উদ্বোধনী ফলক থাকবে। কিন্তু সেই ভবন আদৌ সাধারণ মানুষের কাজে লাগলো কি না দেখার কেউ নেই। অর্থের এমন অপচয় পৃথিবীর আর কোথায় হয় আমার জানা নেই। শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের পরেও যে দেশে ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় না, জানি না কথায় কথায় সেই দেশকে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে কী করে তুলনা করা যায়।
আমাদের নীতিনির্ধারক আর ক্ষমতাবানেরা তো কথায় কথায় সিঙ্গাপুর কিংবা থাইল্যাÐে চলে যান, স্বাস্থ্যেসেবা নিয়ে এই দেশের মানুষকে কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয় সেটা কী তারা জানেন? আমার মনে হয়, পৃথিবীর খুব কম মধ্য আয়ের দেশের মানুষকেই স্বাস্থ্যসেবায় এতো দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আশা করছি আমাদের নীতিনির্ধারকদের বোধ ফিরবে। আশা করছি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দ্রæত কার্ডিয়াক সার্জারি শুরু হবে। আশা করছি এই দেশের প্রত্যেকটা জেলায় একটা মডেল হাসপাতাল হবে যেখানে মানুষেরা একটু ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাবেন, প্রতিটা জেলায় অন্তত সরকারি আইসিইউ থাকবে।
আমি এদেশের বহু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরেছি। বিবর্ণ চেহারা দেখলে কষ্ট লাগে। অনেক জায়গায় ডাক্তারদের বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। কোনো সন্দেহ নেই দেশের স্বাস্থ্য খাতে অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে, কিন্তু তারপরেও অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নিয়ে একটা আইসিইউর জন্য স্বজনেরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরছে এবং এরপর বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? আচ্ছা, নাগরিকেরা যদি ঠিকমতো চিকিৎসা সেবা না পায়, সেই দেশের চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে? আশা করছি আমাদের নীতিনির্ধারকদের বোধ ফিরবে। লেখক: অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান, ব্র্যাক
