
আঞ্চলিক ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনীতি

সুব্রত বিশ্বাস
শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এক নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান আর্থিক সংকটের ফলে মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ সুদের হার এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে ফরেন রিজার্ভের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আরো টেকসই অবস্থানে গেছে দেশটি, যা সম্ভব হয়েছে দৃঢ় সিদ্ধান্তের কারণে।
রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বিদ্যুতায়ন কিংবা আর্থসামাজিক খাতে বাংলাদেশ অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই গত তিন যুগে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে আটগুণ। শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত ব্যয়ের সক্ষমতা অর্জন করেছে পরিবারগুলো। শিল্পখাতে অর্থসরবরাহ বাড়ানোর পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে ব্যাংকগুলোতে। দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশ অর্জন করেছে অসামান্য সাফল্য। অর্থনৈতিক কর্মকাÐে বেড়েছে নারীদের অংশগ্রহণ।
আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তি ছড়ান। অনেকে বাংলাদেশের আকাশে শ্রীলংকার ছায়া দেখছেন, আবার কেউ কেউ উল্লেখ করছেন দেশ শ্রীলংকার পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে, কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এ সেতুর দীর্ঘমেয়াদী একটা প্রভাব হবে সূদুরপ্রসারী। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে অন্য মেগা প্রকল্পগুলো গৃহীত হয়েছে। আর শুধু ঋণ নয়, বিদেশি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে’।
বৈশ্বিক কারণ ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ব্যবসায়ীদের কারসাজিও মূল্যস্ফীিতর পেছনে ভ‚মিকা রেখেছে বলে মনে করি, ১০৪ ট্রিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক জিডিপির ভিত্তিতে ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্ট ১৯১ দেশের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৩৯৭ বিলিয়ন বা ৩৯ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র ভারতই বাংলাদেশের উপরে রয়েছে।
বাংলাদেশ সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়নের পথে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। বর্তমান শুল্ক এবং কোটামুক্ত সুবিধা শুধু ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইইউ বাজারে পাওয়া যাবে। যা গার্মেন্টস শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে সহযোগিতা করবে। ডলারের সংকট দ্রæতই কাটবে না। যদিও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের যে ভারসাম্যহীনতা সেটা কমে আসছে। চলতি অর্থ বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি ১৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। যতদিন সম্ভব ছিল আওয়ামী লীগ সরকার ততদিন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করেনি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ে যেতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিগত ছয় মাসে (ফেব্রæয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রিতে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে দেশে ভোক্তারাও তার সুফল পাবেন। সারা বিশ্বে এখন দাম কমে আসছে। সব জায়গায় কমা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশও কম দামে কেনা শুরু করেছে। এগুলো যখন দেশে এসে পৌঁছাবে, তখন চাপ থাকবে না।
দেশটি তার মুদ্রার মানের পতন ঠেকাতে মুক্তবাজারে ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রয়েছে, যার ফলে যেকোনো দুর্যোগের পরিস্থিতি মোকাবেলায় তহবিল সংরক্ষণ করছে, পাশাপাশি সতর্কভাবে রাজস্ব ঘাটতি এবং চলতি হিসাবের ভারসাম্য পরিচালনা করে আসছে। বৈদেশিক মুদ্রার কোষাগার সংকুচিত হওয়া এবং বিশ^ব্যাপী মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ অংশ একই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। নির্বাচনের বছরকে কেন্দ্র করে সাধারণত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবসময়ই একটা ঊর্ধ্বমুখী ট্রেন্ড দেখা যায়, তার একটা প্রভাব থাকবে অর্থনীতিতে।
বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ গড়ে ৭ শতাংশের ওপরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অর্জন করেছে। আর এর ফলে তিন দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৯ গুণ বেড়ে ২০২০ সালে ৩৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিলো মাত্র ৩৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৬৪ ডলার হয়েছে। বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। দারিদ্র্যের হার ৫৮ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। ওয়েবিনার, জুম, স্ট্রিমইয়ার্ডের মতো নতুন মিডিয়ার ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ই-মার্কেটিং, ফুড টেকওয়ের মতো কিছু ব্যবসার উন্নতি হয়েছে, একই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৬৪ ডলার হয়েছে। বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। দারিদ্র্যের হার ৫৮ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে।
কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ প্রবৃদ্ধিতে যাচ্ছে বিশ^ অর্থনীতি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের দেশে দেশে। ফলে বাংলাদেশসহ রপ্তানিনির্ভর দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ আরো বাড়ছে। বৈশ্বিক শ্লথ প্রবৃদ্ধি ও সুদের হার বৃদ্ধি এ অঞ্চলের বিনিয়োগ ও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
‘খাদ্য ও জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে। এর পাশাপাশি কঠোর মুদ্রানীতি ও নাজুক রাজস্ব অবস্থাও এর অন্যতম কারণ। ২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৫.৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা আরো কমে হবে ৪.৮ শতাংশ। এ বছর বৈশি^ক প্রবৃদ্ধি আসবে ১.৯ শতাংশ, যা ২০২২ সালের ৩ শতাংশ থেকে প্রায় অর্ধেক কমবে। তবে মূল্যস্ফীতি কমে এলে ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছুটা গতি এলে ২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে হবে ২.৭ শতাংশ’। সূত্র : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ।
সরকার যখন ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করে, তখন মূলত বøু-ইকোনোমির বিষয়টি সামনে আসে। ডেল্টা প্ল্যানে বøু বা নীল অর্থনীতির জন্য একটি পৃথক অধ্যায় রাখা হয়েছে। যেখানে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে তহবিল সংগ্রহে ‘বøু বন্ড’ চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেক দেশ এর মধ্যে এ ধরনের বন্ড ইস্যু করেছে। আমরাও নীল অর্থনীতির সম্ভাবানাকে আরো আকর্ষণীয় করতে পারব, তখন এ ধরনের বন্ড ইস্যু করা যেতে পারে।’ দেশের সুমদ্রসীমার বিষয়ে রায়ের পর বহু বছর পার হলেও সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাবে নীল অর্থনীতির অগ্রগতি তেমন হচ্ছে না। নীল অর্থনীতিকে আরো এগিয়ে নিতে ডেল্টা উইং গঠন করা যেতে পারে।
গত ছয় বছরে দেশের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। এ প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নীচে নামলেও ২০৪০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করবে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ হলে এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যেই ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
যতই মন্দার পূর্বাভাস দেওয়া হোক না কেন, মন্দার ঢেউ আমাদের ওপর খুব একটা লাগবে না। বাংলাদেশ মন্দায় পড়ার শঙ্কায় থাকা দেশগুলোর তালিকায় নেই। অর্থনীতির প্রায় সব সূচক ভালো অবস্থায় আছে। নতুন নতুন বাস্তবতার সঙ্গে বিশ্বে মিথস্ক্রিয়া এবং ব্যবসার জন্য নতুন আইসিটিভিত্তিক উদ্যোগের জন্ম দিতে পারে। যদিও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার নতুন বছরে ছয় শতাংশ বা তার আশেপাশেই থাকবে বলে বলছে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ। সবমিলিয়ে ২০২৩ সালটি হবে বাংলাদেশের জন্যেও অত্যন্ত বিচক্ষণ ভাবে সবকিছু মোকাবেলা করার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বছর। লেখক: ব্যবসায়ী
