
অর্থনীতি অসম হলে বিশ^ অশান্ত হবে

গোলাম সারোয়ার
শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৩ অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। অন্যদিকে শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে মোট বেকার মানুষের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৩০ হাজার। সে হিসেবে আমাদের আশার খবর হলো, দেশে বেকারের সংখ্যা কমেছে। এর ভেতরে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, প্রতিবছর নতুন প্রায় ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। শ্রমশক্তি জরিপ এর আগে হয়েছিলো ২০১৭ সালে। তখন দেশে বেকারের সংখ্যা ছিলো ২৭ লাখ, যা সে সময়ের মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক দুই শতাংশ ছিলো। সর্বশেষ বর্তমান জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশে শ্রমশক্তির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেকার।
এখন দেখি বৈশ্বিক বেকারত্বের হিসাবে আমাদের অবস্থান কেমন। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার মতে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বে বেকারের সংখ্যা হবে ২০ কোটি আশি লাখ, যা পৃথিবীর শ্রমশক্তিতে নিয়োজিত মোট জনগোষ্ঠী ৫.৮ শতাংশ। এই হিসাব মাথায় নিলে আমাদের অবস্থা আশাপ্রদ। ২০১৭ সাল থেকে হিসাবে নিলে আমাদের শ্রমবাজারে নতুন করে প্রায় এক কোটি বিশ লাখ মানুষ প্রবেশ করেছে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে পরিস্থিতির উন্নতি করতে হয়েছে। এর ভেতরে পৃথিবীতে দুটো ইমার্জেন্সি গেলো। একটি হলো ব্যাপক-বিস্তৃত করোনা মহামারি এবং গত বছরের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই দুটি বড় বিপর্যয় ঠেকিয়ে বেকারত্বের পরিস্থিতি উন্নয়ন জাতি হিসেবে আমাদের জন্য আশার।
তবে অর্থনীতিতে যে হিসেবে বেকারত্বের সংজ্ঞা বিবেচনা করা হয় তা নিয়ে সমালোচনা আছে। বেকার বলতে এখন তাদেরই ধরা হয়, যারা গত সাত দিনে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকলেও একঘণ্টাও কাজ করতে পারেনি এবং গত ৩০ দিনে বেতন মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কাজ খুঁজেছেন। এই হিসাব মাথায় নিলে পৃথিবীতে বেকারের সংখ্যা বাড়ে। প্রচ্ছন্ন বেকারের সংখ্যা হিসাবে চলে আসে।
পৃথিবীতে বেকারত্ব বাড়ার কারণ দিনে দিনে বাড়ছে। সম্পদ পুঞ্জীভ‚ত হচ্ছে, প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও রূপান্তর বাড়ছে, অটোমেশন বাড়ছে, নি¤œ দক্ষতার চাকরি কমছে। এর ভেতরে শ্রমবাজারে যে হারে মানুষ প্রবেশ করছে, সে হারে কর্মসৃজন করা কঠিন। কঠিন এ কারণে যে, সম্পদ যাদের হাতে পুঞ্জীভ‚ত হচ্ছে তাদের অনেকের সততার ঘাটতি আছে, আছে অব্যবস্থাপনা।
এ পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? প্রথমত আমাদের মনে রাখতে হবে শ্রমবাজারে সরকারি খাতের অবদান খুব কম। পুরো শ্রমবাজারে সরকার মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশের নিয়োগদাতা। তাহলে বাকিদের কর্মসৃজন কারা করছে? বেসরকারি খাত। এখানেই নজর দিতে হবে। নতুন শিল্প চাহিদা মাথায় রেখে একাডেমিগুলোকে সাজাতে হবে। একাডেমি এবং শিল্পকে কাছাকাছি আনতে হবে। দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে পারলে বিদেশ থেকে রেমিটেন্স আসবে আরো বেশি। পৃথিবীতে এখন কোথাও দক্ষতার বিকল্প নেই। সেটা দেশের ভেতরের শিল্পে হোক, রপ্তানিমুখী শিল্পে হোক কিংবা বিদেশে হোক। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ ও মন্দা আসবেই পৃথিবীতে। এটি সুপ্রাচীন কাল থেকে আসছে। প্রথমটি আসে জাতিগত হেজিমনি থেকে। দ্বিতীয়টি আসে প্রকৃতির পার্মুটেশন কম্বিনেশনের কোনো না কোনো রহস্যময় খেলা থেকে। যুদ্ধ কিংবা মন্দা যাই আসুক না কেন, পৃথিবীতে সে জাতিই টিকে যাবে যারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দক্ষতায় ফিট থাকবে।
যেহেতু দেশের বেশির ভাগ শ্রমবাজার অপ্রাতিষ্ঠানিক সেহেতু এখানে বিনিয়োগের সহজ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের ডাটাবেইজড তৈরি করতে হবে। বড় ব্যবসায়ীরা যেমন ঋণ পায় তারাও যেন সহজে ঋণ পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণ নিয়ে যারা ফেরত দেন তাদের আলাদা তথ্য প্রকাশ করতে হবে। যারা ফেরত দেন না, তাদের ডাটাও প্রকাশ করতে হবে। যারা ঋণ খেলাপি, যারা অর্থপাচারকারী তাদের ডাটা প্রকাশ করতে হবে।
দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবা দেওয়ার লোকের অভাব আছে। আবার একই সময়ে দেশে শিক্ষিত বেকারও আছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি নিয়োগ বাড়াতে হবে। এটি সাড়ে তিন শতাংশ থেকে পাঁচ ছয় শতাংশে উন্নীত করতে হবে, যেহেতু দেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে, সেবার আওতা বাড়ছে। সরকারি প্রণোদনা দেওয়ার সময় যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করে না তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশে বহু বিদেশি দক্ষ শ্রমিক কাজ করে। দেশের শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলে সেসব স্থান দেশীয় শ্রমিক দিয়ে পূরণ করতে হবে।
পৃথিবীতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে সে পরিমাণ সম্পদের যদি সুষমবণ্টন হতো তবে পৃথিবীতে অভাব থাকতো না । আবার সে ক্ষেত্রে বেকার মানুষও থাকতো না । পৃথিবীর আজকের অবস্থার জন্যে দায়ী হলো সম্পদের পুঞ্জীভ‚তকারীরা। অক্সফামের প্রতিবেদন অনুসারে আমরা জানলাম পৃথিবীর ৬৩ শতাংশ সম্পদের মালিক হলো এক শতাংশ ধনী মানুষ। এতে অসুবিধা কী হয়? সম্পদ কোনো একক মানুষের কাছে চলে গেলে তা হয়ে যায় অলস। তখন অর্থনৈতিক কর্মকাÐে পারফর্ম কমে। অর্থের প্রাণচাঞ্চল্য কমে। তখন একদিকে মানুষ অনাহারে মরে অন্যদিকে সম্পদ পড়ে থাকে অব্যবহৃত খাতে কিংবা অমানবিক খাতে। বর্তমান বিশে^ যুদ্ধের আর অস্ত্রের অর্থনীতির দিকে চোখ দিলেই আমাদের আতঙ্কে শিহরিত হতে হয় ।
আমরা দেখছি সম্পদ কেন্দ্রীভ‚ত হওয়াতে এবং সম্পদের অপব্যবহারে পৃথিবীতে অনাচার বাড়ছে। বর্তমান বিশ্বে যে পরিমাণ সম্পদ আছে, কারিগরি উন্নয়ন ঘটিয়ে সে সম্পদ দিয়েই পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজন পুরিয়ে আরো বিপুল সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকার কথা। আমরা একটু মিলিয়ে দেখতে পারি। পৃথিবীতে বর্তমানে চাষযোগ্য ভ‚মি হলো ৮৫০ কোটি একর। এর মধ্যে মধ্যে মাত্র ৩৫০ কোটি একর জমিতে চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ৪০০ কোটি একর জমি দো-ফসলা। জমির পরিমাণ না বাড়িয়েও শুধু উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার করে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব। আবার শুধু সেচ ও সারের ব্যবহার বাড়িয়ে বর্তমান প্রযুক্তি দিয়েই খাদ্য উৎপাদন তিনগুণ করা সম্ভব। এর মানে হলো, বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমানের কর্ষিত জমির পরিমাণ অপরিবর্তিত রেখেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব পাঁচগুণ। এই অভিক্ষেপ হলো ম্যাক্স সিঙ্গার নামের প্রখ্যাত মার্কিন বিশেষজ্ঞের। তবে এসব বাস্তবায়ন করতে পারবে বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা। বর্তমান বিশ্বের মোটা দাগে শ’দুয়েক মানুষ সঠিক চিন্তা করলেই পৃথিবী নিরাপদ ও ক্ষুধামুক্ত হয়ে যায়।
বিশ্বের বিদ্যমান চাষযোগ্য ভ‚মি ব্যবহার করেই যে পৃথিবীর ক্ষুধা দূর করা সম্ভব তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এদেশের মানুষের মাথাপিছু ভ‚মির পরিমাণ ০.২৮ একর। এই পরিমাণ ভ‚মি হলো পৃথিবীতে কোনো দেশের জনসংখ্যার হিসেবে গড়ে সবচেয়ে কম ভ‚মি। এই পরিমাণ ভ‚মি ব্যবহার করেও বাংলাদেশের কৃষকেরা প্রধান খাদ্যশস্যে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে ফেলেছেন। তার মানে বাংলাদেশের কৃষকদের মানে পৃথিবীর কৃষকেরা দায়িত্ব নিলে পুরো পৃথিবীর ক্ষুধা দূর করতে পৃথিবীর সামান্য ভ‚মিই ব্যবহার করা লাগে। আধুনিক প্রযুক্তি যোগ করলেতো আরো কম লাগে।
তাহলে পৃথিবী ক্ষুধা কেন থাকবে? কেন থাকবে দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র? বর্তমান পৃথিবীতে একদিকে হাজার হাজার টন খাদ্যশস্য নষ্ট করা হচ্ছে আবার অন্যদিকে আফ্রিকাসহ অনেক দেশে মানুষ অনাহারে মরছে। সম্পদ গুটিকয়েক ব্যক্তির কাছে পুঞ্জীভ‚ত হলে কর্মসংস্থান সেভাবে হবে না, ক্ষুধা দূর হবে না। সে জন্য হতে হবে সম্পদের সুষমবণ্টন, অন্তত ব্যবধান সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। আমাদেরও এখন ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। এই অসম বিভেদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। ধনীদের সাহায্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়াতে হবে।
আগামী দশকে পৃথিবীতে আরো শতকোটি তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে। বর্তমান শ্রমবাজারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষমতা অনুযায়ী মাত্র ৪০ শতাংশ তরুণ-তরুণী কাজ পাবে। বাকিরা কোথায় যাবে? কর্মসৃজন না করতে পারলে তারা হবে হতাশাগ্রস্ত। আর হতাশাগ্রস্ত মানুষ মাত্রই বিপদজনক। তাদের বিপদগামী করা সহজ। সে কাজ করার লোক কিংবা সংগঠনেরও পৃথিবীতে অভাব নেই। সুতরাং অর্থনৈতিক সুষম গণসম্পৃক্ততা এবং কর্মসৃজন ছাড়া পৃথিবীর শান্তির আশা নেই, স্বস্তির আশা নেই।
লেখক : কলামিস্ট
