
সম্ভাবনার বাংলাদেশের অর্থনীতির যোগ-বিয়োগ এবং ভাগ ফল!

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
[২] বাংলাদেশের অর্থনীতির জোয়ান কাল চলছে। তারুণ্যের কাল শেষ করে যৌবনে পা দিচ্ছে। ফলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বাধাবিপত্তি থাকা সত্তে¡ও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারছে না। পারবেও না। যখন বিপদ আসে, দেখবেন সবদিক থেকেই আসে। আপনি কিছুই বুঝে উঠতে পারবেন না, এর আগেই বিপদ-আপদ এসে হাজির হবে! আপনার সতর্ক পদক্ষেপেও বিপদ থেকে রক্ষা মিলবে না। একটা সময় প্রকৃতির নিয়মেই বিপদ কমে আসে, কষ্টের মাত্রাও হ্রাস পায়Ñএর আগে আপনাকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতি নীরবে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তেমনি আপনার যখন সুসময় থাকবে, একটার পর একটা ভালো সংবাদ পেতেই থাকবেন। আপনি না চাইলেও সাফল্য যেন আপনার পায়ে এসে লুটিয়ে পড়েÑব্যাপারটা বানোয়াট কী! আপনি কি আপনার জীবনে এমনটি দেখছেন না? নিশ্চয়ই দেখছেন। যখন বিপদ ভর করে, সহজে শেষ হতে চায় না। আবার যখন সুসময় যায়, তখন সেটাও অনেক দিন চলতে থাকে।
[৩] বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম একাত্তরে, সাগর রক্ত বিনিময়ে। জন্ম যন্ত্রণায় আমরা কাতরাচ্ছিলাম। বিশ^ ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যাকালে অনেকেই আমাদের নিপীড়ন-নির্যাতন দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখেছে। কিন্তু পাশে ছিলো না। অনেক বড় বড় রাষ্ট্র, যারা এখন আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। আবার অনেক বড় বড় রাষ্ট্র আমাদের পাশেও ছিলো। প্রতিবেশী দেশটি তো ছিলোই, এর বাইরেও মানবতবাদী রাষ্ট্রগুলো আমাদের পাশে ছিলো। পাকিস্তানি বর্বরতা থেকে আমাদের মুক্ত থেকে সহযোগিতা করেছিলো। সেই সময়টা ছিলো আমাদের ব্যয়ের কাল। মাইনাস বা বিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগও কি ছিলো না সেই সময়টা? লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগÑএর চেয়ে বড় বিনিয়োগ কী আর হতে আর! আমরা সেদিন শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। স্বাধীনতার সংগ্রামে আমাদের বিজয় হয়েছিলো, কিন্তু জনকের মুক্তির সংগ্রাম আমাদের জারি ছিলো। আমরা রাজনৈতিকভাবে মুক্তি পেলেও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিলাম বিশ^ থেকে। খুব খারাপ ছিলো আমাদের অর্থনীতি। যুদ্ধের সময় সবকিছু তছনছ করে দিয়েছিলো পাকিস্তানি বর্বররা। আমাদের নতুন করে গড়তে হয়েছিলো। সেটা শুরু হয়েছিলো জাতির জনকের নেতৃত্বেই। আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলাম। আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এ দেশের দুশমন, পাকিস্তানি দোসররা তখনো এই বাংলায় ছিলো। ওৎ পেতে থাকা হায়েনারা বাংলার হৃদপিÐে আঘাত হানলো। জনককে হত্যা করলো স্বপরিবারে। এটা ছিলো আমাদের বিয়োগ কাল। কষ্টের সময়। হারানোর যন্ত্রণায় আমরা কাতর হয়েছিলাম।
[৪] বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসক ও স্বৈরাচার মিলে উলোটপালট করে দিলো সবকিছু। পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালালো। নানান উদ্যোগও নিলো দেশকে পাকিস্তানি চেতনায় ফিরিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে। কিন্তু বাঙালিকে সাময়িক ঠকানো গেলেও দাবিয়ে রাখায় যায় না, এটা বুঝতে পারেনি সামরিক শাসকেরা। যার ফলে তারা যা-তা সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশকে জাহান্নামের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছিলো! জনতা ঘুরে দাঁড়ালো। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রমাগত পিছিয়ে যাওয়া একটি দেশ ছিলো। সময়টি বড়ই দুঃষহ, যন্ত্রণার ছিলো। বাঙালি জাতি দিন গুণছিলো কবে মুক্তি মিলবে সামরিক, স্বৈরশাসকদের কবল থেকে।
[৫] মুক্তি মিললো অবশেষে। জাতির জনকের কন্যা রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব নিলেন। দেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। এ সময়টা বাংলাদেশের জন্য সুসময়। ভালো কিছু অর্জনের কাল। এই সময়ে আমরা অর্থনৈতিক ভঙ্গুর দশা থেকে মুক্তি পেতে নানান উদ্যোগ নিতে দেখি। কর্মসূচি দেখি। ধীরে ধীরে মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। আশার বাতি হয়ে এলেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত বাংলাদেশকে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ২০০১ সালের শেষের দিকে নীলনকশার নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষমতায় আসে একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত আর সামরিক শাসকের দল বিএনপি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালÑএ এক অন্ধকার সময়। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্র্নীতি, লুটপাটÑএ এক হরিলুট সময় ছিলো। বাংলাদেশকে জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়েছিলো বিএনপি-জামায়াত জোট। এটাও তো বিয়োগ কাল ছিলো বাংলাদেশের জন্য। কেবলই হারানোর সময়। বেদনার সময়। দেশকে শূন্য করে দেওয়ার কাল। কী করে ভুলে মানুষ ওই দুঃশাসনের অন্ধকার যুগ।
[৬] সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দুই বছর শেষে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ জোট। বাংলাদেশ আলোর পথে যাত্রা শুরু করে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শুরু হয়। ২০০৯ থেকে ২০২৩Ñএ সময়কালে আমরা বিশে^ অর্থনীতির বিস্ময় হিসেবে হাজির হয়েছি। আমরা পদ্মা সেতু করেছি নিজেদের অর্থে। আমরা মেট্রোরেল করেছি। আমরা পাতাল করছি। আমরা বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ করেছি। আমরা সমুদ্র জয় করেছি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ করেছি। আমরা রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প করছি। আমরা দেশের বিভিন্ন শহরে ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছি। যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গত ১৪ বছরে দেশ-বিদেশে কতো কতো সংকট তৈরি হয়েছে, সব সংকটে আমাদের অবস্থান ছিলো দৃঢ়। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ রূদ্ধ করতে পারেনি কোনো সংকটই। সংকটে আমরা জিরিয়ে নিয়েছি, খানিকটা বিশ্রাম নিয়েছিÑকিন্তু পিছিয়ে যাইনি।
[৭] একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানিরা এখন বাংলাদেশ হতে চায়। দেউলিয়া হওয়ার পথে এই ব্যর্থ রাষ্ট্রটি। দীপদেশ শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত করোনায় খাবি খেয়েছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তাদেরÑকিন্তু আমরা ছিলাম স্থির। দৃঢ় প্রত্যয় ছিলো। তখনো আমরা পিছিয়ে যাইনি। আমরা এগিয়েছি। করেনাকালেও আমাদের অর্থনীতি ভালো ছিলো। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ^কে টালমাটাল করে দিয়েছে। বিশে^র বহু দেশ দেউলিয়া হবার পথে অথবা অর্থনৈতিকভাবে খুবই নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে সেসব দেশ। আমরা লড়াই করছি। আমাদেরও কষ্ট হচ্ছে অনাকাক্সিক্ষত এই যুদ্ধে। দেশে দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। আমাদের এখানেও তার আঁচ লেগেছে। সময়টা আমাদের জন্যও খুব সুখকর নয়। তবুও বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়লেও আমরা আমাদের চেষ্টা দিয়ে, দরদ-আন্তরিক চেষ্টা করছি, দুঃসময়কে পার করে দিচ্ছি। আমাদের পোশাক খাত শক্তিমত্তা দেখাচ্ছে, আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা দেশকে এগিয়ে নিতে প্রতিনিয়তই কাজ করে যাচ্ছেন। রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশকে স্বস্তি দিচ্ছেন।
[৮] বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে দেশকে দেওয়া শুরু করেছিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নেওয়া পদক্ষেপসমূহ ছিলো আমাদের জন্য খুবই অর্থবহ। এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র। কেবলই যোগ করার পালা। কিন্তু পনের আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ছিলো আমাদের বিয়োগ কাল। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত যোগকাল। ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত বিয়োগের সময়। এই সময়ে দেশকে এগিয়ে তো নিতে পারেইনি, ক্রমাগত পিছিয়ে গেছে কেবল। ২০০৯ থেকে ২০২৩Ñ কেবলই এগিয়ে যাওয়ার সময়। বারবার বিশ^কে চমকে দেওয়ার কাল। চমকের এখনো শেষ হয়নি, কেবল শুরু মাত্র।
[৯] এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়বো। মধ্যম আয়ের দেশকে উন্নত বাংলাদেশ। কেবল কথার কথা নয়, বাস্তবতা। বহু উদাহরণ আছে। বহু উন্নয়ন গল্প এই সময়ে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে। যোগ, বিয়োগ আর ভাগ শেষে যোগফল বাংলাদেশের অনুক‚লে। ভাগশেষে কী দাঁড়াচ্ছে? বাংলাদেশ এখন ভালো আছে। খুব ভালো। সংকট আছে, তবুও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের এখন গোল্ডেন সময়। জিপিএ ফাইভ পেয়ে উক্তীর্ণ হয়েছে। ভ‚মিধস এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে। এখনই সময় এ দেশের দুশমনদের সম্পর্কে সাবধান হওয়ার। কারণ ঘাতকেরা সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। আমরা কি সেই ছোবল আর খেতে চাইবো! বোকারাও জেনেশুনে বিষপান করতে চায় না! আমাদের আর ছোবল মারার সুযোগ নেই। সেই সুযোগ দেবোও না আর আমরা।
পরিচিতি: অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, স¤প্রীতি বাংলাদে
