
অর্থনীতির ঝুঁকি এবং একটি ‘মৃত বিড়াল’!

কাকন রেজা
অর্থনীতি বিষয়ে একটি খবরের শিরোনাম ছিলো এরকম, ‘অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছে’। খবরটি করেছে দৈনিক মানবজমিন। ঝুঁকির মূলত তিনটি কারণের কথা বলেছে দৈনিকটি। রিজার্ভ সংকট, রপ্তানি আয়ে ভাটা এবং রেমিট্যান্স কমে যাওয়া। এছাড়াও আরো কারণ বলা হয়েছে। যা এগুলোরই অনুষঙ্গ। ইতিহাস সৃষ্টি করে রিজার্ভ নেমে এসেছে ত্রিশ বিলিয়নের নীচে। খবরটিতে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের বরাতে বলা হয়েছে, প্রকৃত রিজার্ভ বাইশ বিলিয়ন বা তারও কম। যা আছে তা দিয়ে আইএমএফ-এর টার্গেট পূরণ হবে না। এটা আরেক ক্যাচাল। আইএমএফের ঋণ নিতে গিয়ে সত্যিকার অর্থেই ক্যাচাল দানা বাঁধছে। সব গোপন কথা বের হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মানুষকে অন্ধকারে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। যে কারণেই জানা যাচ্ছে বিদেশের ব্যাংকগুলোতে কী পরিমাণ পাচারকৃত টাকা রয়েছে বাংলাদেশের। প্রকৃতপক্ষে কতোটাকা বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে এ পর্যন্ত। ফাঁস হচ্ছে রিজার্ভের গোপনীয়তাও। দৈনিক কালের কণ্ঠের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহে রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৯.৮১ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফের গণিতের ধারায় ৫.৫ বিলিয়ন বাদ দিয়ে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের অঙ্ক হবে ২৪.৩১ বিলিয়ন ডলার। যারা অর্থনীতি বোঝেন তারা এই গণিতের সংকটটাও বোঝেন। বোঝেন কতোটা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে অর্থনীতি।
এর মধ্যে রপ্তানি আয় কমেছে। যার অর্থ হলো ডলার সংকট আরো বেড়েছে। ডলার সংকটকে প্রায়শই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়। বলা হয় সব ঠিক আছে, বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ানো হয়। একশ তিন টাকা থেকে লাফ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে একশ চার টাকা পঞ্চাশ পয়সা দরে। তাও শুধু আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য কয়েকটা মাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কাছে ডলার বেচছে বিবি, মানে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংকটা তো বোঝা যাচ্ছে নাকি? ‘আক্কেলমান্দ কি লিয়ে ইশারা কাফি’ হওয়া উচিত।
জাহাজের খবর থাক, আদার খবরে আসি। ধাপে ধাপে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। আবার বাড়ানোর পায়তারা চলছে বলে খবর করেছে গণমাধ্যম। অবশ্য দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সমন্বয়ের কথা। এটা যে আইএমএফের ঋণের ধাক্কা, তা দায়িত্বশীলরা স্বীকার না করলেও, প্রেক্ষাপটের দৃশ্যমানতা অস্বীকার্য। আইএমএফ যে পরিমাণ ঋণ আমাদের দিচ্ছে, তা আমাদের সমস্যা সমাধানে শিশির বিন্দু বলা যায়। কিন্তু এটুকু পেতেই আমাদের যে পরিমাণ ছাড় দিতে হচ্ছে, তাতে দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষোভ। ক্রমাগত বিদ্যুত, গ্যাস, জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে মানুষ এমনিতেই ভালোভাবে নেয়নি। বিদ্যুতের দাম আবার বাড়লে এবং সঙ্গে পুনর্বার গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তা মানুষকে আরো বিক্ষুব্ধ করে তুলবে। একইসাথে সার্বিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে নিশ্চিত। বিশেষ করে ক্ষুদ্র শিল্পগুলো ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে। অবস্থা সামাল দিতে না পারলে হঠাৎ করেই ধসে পড়বে পুরো কাঠামোই।
একদিকে ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পগুলো ভুগছে কাঁচামাল সংকটে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বাড়তি দামের কারণে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। এটা অর্থনীতির একটা সহজ সূত্র আর সে সূত্রের সমীকরণে ক্ষুদ্র শিল্প লোকসানের মুখে। বাধ্য হয়েই তাদের কর্মী তথা শ্রমিক ছাটাই করতে হচ্ছে। উপসর্গ হিসেবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্ব। যার আরেক উপসর্গ হলো অপরাধ বৃদ্ধি। মানুষের উপার্জনের রাস্তা না থাকলে সঙ্গতই অপরাধে যুক্ত হয়। চট্টগ্রামের ট্রলারের দশ লাশ তার সা¤প্রতিক প্রমাণ। যতদূর জানা গেছে মৃতরা ডাকাতি করতে গিয়েছিলো সাগরে এবং জেলেদের প্রতিরোধের মুখে মারা পড়েছে। এদের অনেকেই পেশাদার ডাকাত নয়, এটাই তাদের প্রথমবার। সুতরাং এই যে প্রথমবারের সমুদ্রে ডাকাতি করতে যাওয়া এবং এমন অপরাধ প্রচেষ্টার মনস্তত্ত¡টা বোঝার চেষ্টা করা উচিত। আর সে চেষ্টাটা বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরিও। এটাও একটা সূচক এবং সে সূচক অর্থনীতির বিপর্যয়ের।
খবরের মাধ্যমে নজর রাখলে দেখা যাবে ক্রমেই অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। মুক্তিপন, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের খবর দিচ্ছে মাধ্যমগুলো। এটাকে নজরআন্দাজ করা হবে নিজের পায়ে কুড়োল মারার সামিল। সুতরাং নিজের পাটা সামলে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
একটা গল্প বলে শেষ করি। গুরু ও শিষ্য মিলে ঘুরতে ঘুরতে এক নগরের প্রবেশদ্বারে এসে হাজির। কিন্তু ঢুকতে গিয়েই দেখা মিললো একটা মৃত বিড়ালের। গুরু মৃত বিড়ালটাকে মনোযোগ সহকারে দেখতে শুরু করলেন, পর্যবেক্ষণ যাকে বলে আর কী। অনেকক্ষণ দেখার পর তিনি বলে উঠলেন, এ নগরে যাওয়া যাবে না। শিষ্য প্রশ্ন করলো, কেন যাওয়া যাবে না প্রভু? উত্তরে গুরু বললেন, খাওয়ার মতন উচ্ছিষ্টও অবশিষ্ট নেই এই নগরে। যার ফলেই বিড়ালটা না খেতে পেয়ে মারা গেছে। এ নগর আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। অতএব বিড়াল মরার লক্ষণ দেখেই সাবধান হওয়াটা জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
