
বাংলাদেশ কেন বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয়?

সুব্রত বিশ্বাস
অর্থনৈতিক সংস্কার, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ক্ষুদ্রঋণ, উন্নত অবকাঠামো এবং জনগণের উদ্যোক্তা মনোভাবসহ বেশ কয়েকটি কারণ গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে চালিত করেছে। উপার্জনকারী এবং ভোক্তাদের একটি ক্রমবর্ধমান তরুণ জনসংখ্যা, বাংলাদেশকে শ্রম এবং দক্ষতা-নিবিড় খাতের জন্য একটি আদর্শ বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত, ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তাদের বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার দিকে পরিচালিত করেছে, যা দেশের বেসরকারি খাতের মেরুদÐ গঠন করে।
ব্যবসাকে আকৃষ্ট করার জন্য নিয়ন্ত্রক পরিবেশের উন্নতি, নীতিগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরিষেবাগুলোর আধুনিকীকরণ, বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করে, যা বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করেছিল। সরকার-বেসরকারি খাতে ব্যাংকিং, নন-ব্যাংকিং আর্থিক পরিষেবা এবং বীমা ব্যবসার অনুমতি দিয়েছে। এটি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা অপসারণ করেছে, বাণিজ্য বাধা হ্রাস করেছে এবং ট্যাক্স বিরতি এবং অন্যান্য প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের উন্নীত করেছে।
কিন্তু কিছুদিন আগেও, বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল, যেখানে ১৯৯১ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৯%, যা ২০১৮ সালে ২১ .৮%-এ নেমে এসেছে, ২০২২-২০২৩ সালে দারিদ্র্য হার অপরিবর্তিত ২০ দশমিক ৫ শতাংশই আছে। একই সময়ে, চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ৪৩ % থেকে ১১.৯ %। কোভিড-১৯ মহামারী না হলে সংখ্যাটা আরও বেশি হতো।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৯০ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু ২০২২ সালে এটি ৪৬০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা গত ১৪ বছরে পাঁচ গুণেরও বেশি বেড়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, উদ্যোক্তা মনোভাব এবং উন্নত অবকাঠামো এই বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্দীপিত ভোগবাদের দ্বারা চালিত অভ্যন্তরীণ ব্যবহার অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের দিকে মনোনিবেশ করেছে, যার ফলে টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য এবং ওষুধের মতো শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এটি দেশকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রপ্তানি বাড়াতে সহায়তা করেছে। উন্নত অবকাঠামো: বাংলাদেশ রাস্তা, সেতু এবং বন্দরের মতো অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। সরকার পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেল-সহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যা শিল্পের বৃদ্ধিকে সহজতর করেছে।
বাংলাদেশ কেন বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান? বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ দেশীয় অর্থনীতি, কমপক্ষে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে শুল্কমুক্ত রপ্তানি, স্বল্পমূল্যের শ্রমের উদ্বৃত্ত, উচ্চমানের পোশাক পণ্যের সুযোগ, একটি ক্রমবর্ধমান কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাত এবং একটি ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অর্থনীতি। এছাড়াও দেশের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত জনসংখ্যা, যারা মোট ১৭০ মিলিয়নের প্রায় ২২%, বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে। ২০২৫ সালের মধ্যে সংখ্যাটি মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বা প্রায় ৪০ মিলিয়নে উন্নীত হবে, যা বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি।
সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে এবং সবচেয়ে বড় একটিÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর দেশের বৃহত্তম সমুদ্র বন্দরের কাছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গড়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের পাশাপাশি চারটি রাষ্ট্র-চালিত অর্থনৈতিক অঞ্চল ২২ বিলিয়নেরও বেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই অঞ্চলগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে ঝামেলামুক্ত জমি পেতে পারেন। এছাড়াও জাপানি, ভারতীয় এবং চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য ডেডিকেটেড জোন তৈরি করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ডেডিকেটেড জোনের জন্য অন্য যেকোনো দেশের আগ্রহকে স্বাগত জানায়।
যদিও বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তার জিডিপির প্রায় ৬.২ শতাংশ অবকাঠামোতে, ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এখনও অনেক কিছুর প্রয়োজন? ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির একটি হিসাব অনুযায়ী, অবকাঠামোগত চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে বছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। এই প্রয়োজন বিদেশি অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রকৌশল পরিষেবা সংস্থাগুলোর জন্য প্রচুর সুযোগ দেয়।
বাংলাদেশ দক্ষতার জন্য একটি বিশাল সুযোগ উপস্থাপন করে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য যা একটি কোম্পানি বা বহুজাতিক কর্পোরেশনকে বোঝায় যা উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতার উন্নতির প্রাথমিক লক্ষ্য নিয়ে অন্য দেশে বিনিয়োগ করে। এই বিনিয়োগ কৌশল বাংলাদেশে কম শ্রম খরচ, প্রযুক্তি, অনুক‚ল কর নীতি এবং অবকাঠামোর সুবিধা নেয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ, উপার্জনকারী এবং ভোক্তাদের ক্রমবর্ধমান তরুণ জনসংখ্যার সাথে এটিকে শ্রম এবং দক্ষতা-নিবিড় খাতের জন্য একটি আদর্শ বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত করেছে। উপরন্তু বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান এফডিআই গন্তব্য হিসেবে এর আকর্ষণ বাড়িয়েছে। কিন্তু এই সুযোগগুলোকে বাস্তবে পরিণত করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে, চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে, নতুন প্রজন্মের ব্যবসাকে আকৃষ্ট করার জন্য নিয়ন্ত্রক পরিবেশের উন্নতি, নীতিগুলি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরিষেবাগুলির আরো সহজ আধুনিকীকরণের প্রয়োজন।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৩০০ কোটি মানুষের বড় বাজার সুবিধা নিতে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে অবশ্য একটা বড় সুযোগ। বিনিয়োগবান্ধব আইন বা নীতিমালা করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি অবকাঠামোর বিস্তৃতি সাধন করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সেবা-পরিষেবা অনুমোদনের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিসও চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে পরে আমাদের সমুদ্রপথ, আকাশপথ, রেলপথ সবগুলো ব্যবহার করে এই দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এবং সেই সঙ্গে আমাদের পশ্চিমা দেশগুলোতেও যোগাযোগের বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং পণ্য পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের বাণিজ্য প্রসারে ৪০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে সরকার। কেউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে ১০ বছর পর্যন্ত কর ছাড় দেবে সরকার।
২০৩০ সালের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বার্ষিক অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির প্রত্যাশা নিয়ে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
তথ্যমতে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এরই মধ্যে ৯৭টির অনুমোদন দিয়েছে, যার ১০টি ইতোমধ্যে উৎপাদনে গেছে। যেখানে ৩৮টি উৎপাদনশীল কারখানা আছে। বাস্তবায়নাধীন ২৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। ৭৮টি কারখানা নির্মাণাধীন। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দেশিয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও আসছে। এরই মধ্যে বিদেশি ৩৯টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং করছে। উৎপাদনে আছে ১৩টি বিদেশি কারখানা।
বিশ্বে তৈরি পোশাকশিল্পে বড় চমক দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। নিরাপদ কারখানা ও কাজের পরিবেশের মানের দিক দিয়ে ১০০টি গ্রিন গার্মেন্টসের মধ্যে অর্ধেকের বেশি এখন বাংলাদেশে। তথ্যমতে, ১০ বছর আগে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার সংখ্যা ছিলো মাত্র একটি। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে ১৫৫টি। সরকারি নীতি সহায়তা চলমান থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলার হবে।
স্বাধীনতার পর চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করতে পারতো বাংলাদেশ। বাকি ৮০ শতাংশ ছিল আমদানি নির্ভর। ৫০ বছরে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। চাহিদার ৯৮ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে। রপ্তানি হচ্ছে ১৫৫টি দেশে। ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে ৩০ হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের ওষুধ উৎপাদন করে। এ ছাড়া ১২ হাজার ধরনের বেশি আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হারবাল ওষুধ তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। এসব ওষুধের ৮০ শতাংশ জেনেরিক ও ২০ শতাংশ পেটেন্টেড।
বাংলাদেশ মূলত ম্যালেরিয়া, য²া, ক্যানসার, পেনিসিলিন, কিডনি, ডায়ালাইসিস, হোমিওপ্যাথিক, বায়োকেমিক্যাল, আয়ুর্বেদিক ও হাইড্রোসিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওষুধ রপ্তানি করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করে ১ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা আয় করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগের জন্য একটা উৎকৃষ্ট তম স্থান মনে করি। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল উৎপাদনে গেলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের সোপানে পৌঁছানো সহজ হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
লেখক: ব্যবাসয়ী
