
শিক্ষকদের আয়-রোজগার এবং মানসম্মত জীবন ব্যবস্থার চিত্র কী

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
পত্রিকায় দেখলাম, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ১০ম গ্রেডে বেতনের জন্য আন্দোলন করছেন। দশম গ্রেডে উন্নীত হলে সর্বসাকুল্যে টেক হোম বেতন পাবেন ২৭ হাজার টাকা প্লাস কিছু। বর্তমান বাজারে এই টাকায়ও কি পরিবার নিয়ে চলা সম্ভব? সরকারি অন্যান্য পদে যারা আছেন তাদের নানা সুবিধা ও নানা উপরি আয়ের সুযোগ আছে। শিক্ষকদের সেটা নেই। শিক্ষকদের সৎভাবে বাঁচার ব্যবস্থার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের পাশে কলকাতার প্রাইমারি শিক্ষকরা টাকায় ৩০ হাজারের বেশি পান, অথচ সেখানে বাসা ভাড়া ও জিনিসপত্রের দাম আমাদের চেয়ে অনেক কম। যেমন চিনির কেজি ৫২ টাকা আর আমাদের এখানে ১২০ টাকা। তার মানে ইফেক্টিভ বেতন ৩০ হাজারের চেয়ে বেশ বেশি। অথচ আমাদের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা মাসিক ২৭ হাজার টাকা বেতন দাবি করে এখন রাস্তায়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রভাষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। কথা প্রসঙ্গে একজন প্রভাষকের বর্তমানে টেক হোম বেতন কত জানতে চাইছিলাম। এমনিতে কাউকে তার বেতন কতো জিজ্ঞেস করা ঠিক না। যাহোক আপনারা কি জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষকের যোগ্যতা কি আর তার বেতন কত? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও) শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেতে একজন শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম বিএস (অনার্স) এবং মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৫ পেতে হয়। তবে ন্যূনতম যোগ্যতা যথেষ্ট না। সাধারণত ক্লাসের সেরা ছাত্ররাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পেয়ে শিক্ষক হয়। সেই শিক্ষক মাসে সর্বসাকুল্যে বেতন পান সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা। তার যদি স্ত্রী থাকে, তার যদি একটি বাসা ভাড়া করে থাকতে হয় তাহলে বর্তমান বাজারমূল্যে এই ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে কীভাবে চলা যায় তার একটা হিসাব কি কেউ আমাকে দিতে পারবেন?
প্রভাষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা যেটা দিয়েছিলাম সেটা ন্যূনতম। আমেরিকায় পিএইচডি করে ইন্ডাস্ট্রিতে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (যা পোস্ট-ডকের সমতুল্য) ৩-৫ বছর চাকরি করেও প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার উদাহরণ আছে। আর শুধু পিএইচডি করে প্রভাষক হওয়ার উদাহরণ অনেক আছে। সাধারণত সারা পৃথিবীতে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ হয় সহকারী অধ্যাপক পদে কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় প্রভাষক হিসাবে যদি তার ৩ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা না থাকে। তার অর্থ একজন শিক্ষার্থী মাস্টার্স করার পর ৪ থেকে ৬/৭ বছর গবেষণা ও টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করে পিএইচডি করার পর প্রভাষক হচ্ছে আর বেতন পাচ্ছে মাত্র ৩৫ হাজার টাকা। গোটা বিশে^র মধ্যে বাংলাদেশেই এতো কম বেতন। তাহলে কেন আমাদের মেধাবীরা পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে আসবে বলুন তো? ন্যূনতম বেতন স্কেল যাইই থাকুক পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য বড় একটা ইনক্রিমেন্টতো সরকার দিতে পারে? প্রতি ১ বছরের পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতার জন্য একটা বড় ইনক্রিমেন্ট দিতে পারে। প্রতিটি গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য একটা ছোটখাট ইনক্রিমেন্ট কিংবা এককালিন কিছু টাকা দিতে পারে যেমন বুয়েটে বর্তমান ভিসি এটি ইতোমধ্যেই চালু করেছে।
এভাবে শিক্ষকদের তাদের অতিরিক্ত যোগ্যতার জন্য আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে তাদের পেশার মান বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে। কারণ বর্তমানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে বেতন পান তা দিয়ে কোনোভাবেই চলা সম্ভব না। আর না বলেই শিক্ষকরা বিভিন্ন জায়গায় পার্ট-টাইম কিছু একটা করে বাড়তি আয় করছে। যারা পার্ট-টাইম কোথাও না পড়াচ্ছেন তারা অন্য কোনো ধান্দাবাজি যেমন রাজনীতি, কনসাল্টেন্সি ইত্যাদিতে জড়িত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারা? শিক্ষার্থীরা। কারণ শিক্ষার্থীরা তার শিক্ষকের মেধা ও কাজের সম্পূর্ণটা পাচ্ছে না। তাছাড়া এই কম বেতনের জন্য শিক্ষকরা নানাভাবে নানা উছিলায় কিছু অতিরিক্ত টাকা আয়ের কিছু আপাত বৈধ উপায় বের করছে যেমন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেই পার্ট-টাইম শিক্ষক, নিজের কোর্সের উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য টাকা পাওয়া, একাডেমিক নানা কমিটির মিটিংয়ে উপস্থিতির জন্য এনভেলপ মানি ইত্যাদি। শিক্ষক পদটা এমন একটি পদ যেই পদে থেকে একজনকে উদাহরণীয় মানুষ হতে হয় যেন শিক্ষার্থীরা তার জীবন থেকেও শিখে। কিন্তু আমরা এখন আর উদাহরণই থাকতে পারছি না। দিন যত যাচ্ছে আমরা ততোই কম উদাহরণই হয়ে উঠছি। যতদিন শিক্ষকদের এইসব সমস্যার সমাধান না হবে রাষ্ট্রে ভালো মানের মানুষ তৈরির আশা কেবলই দুরাশা হয়ে থাকবে।
মফস্বল শহর থেকে ঢাকা শহরে মানুষের ঢল আসা কমানোর সবচেয়ে সহজ ও ভালো উপায় হলো, মফস্বলে ভালো মানের স্কুল-কলেজ গড়া। ভালো মানের স্কুল-কলেজ মানে ভালো মানের শিক্ষক থাকা। ভালো মানের শিক্ষক পেতে হলে ভালো ও সম্মানজনক বেতন দিতে হবে। শিক্ষকরা পাজেরোতে চড়ে স্কুল-কলেজে যেতে চান না। সম্মানজনকভাবে বাঁচতে পারলেই তারা সুখী। কারণ শিক্ষক হয়ে সারাজীবন ধরে শিখতে পাড়ার সুযোগ পাওয়াকেই শিক্ষকরা সবচেয়ে বড় পাওয়া মনে করে।
লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
