সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হল অবকাঠামো বিনিয়োগ! সড়ক অবকাঠামো ব্যাবহার না করেই চীন চাইলে সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে দিতে পারে
ওয়াসি মাহিন
ইউটিউব সাজেশনে একটি ভিডিও সামনে এলো। ভিডিওর শিরোনাম এমন কিভাবে ভারত চীনের ক‚টকৌশল নস্যাৎ করে দিল। আগ্রহ নিয়ে দেখলাম পুরাটা। পুরো ভিডিও জুড়ে দেখলাম চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে কিভাবে চীন বিশ্বকে কব্জা করছে সেটার ব্যাখ্যা দেয়া। সেই সাথে স্ট্রিং অব পার্লস থিওরি। শ্রীলংকা, জিবুতি, পাকিস্তানের বন্দর উন্নয়ন করে কিভাবে ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চলছে সেটার সুবিস্তারিত ব্যাখ্যা। কিভাবে চীন চাইলেই ভারত মহাসাগরে ট্রেড রুটগুলিতে বøক করে দিয়ে ভারতকে কব্জা করতে পারে অথবা গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালীসহ অন্যান্য প্রণালীগুলির নিয়ন্ত্রন নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন করছে সেটা ভিডিওগ্রাফিক সুন্দর উপস্থাপনা। এর বিপরীতে মোদি কিভাবে ইরানের বন্দর করছে, ওমানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও মঙ্গোলিয়ার সাথে সম্পর্ক গভীর করে চীনের হুমকি নস্যাৎ করে দিয়েছে সেটার চমৎকার ব্যাখ্যা।
ইন্টারেস্টিং লেগেছে ভিডিওটা। এবার আমার নিজস্ব মত দিয়ে শুরু করি। চীন বিশ্বের পিপিপি হিসাবে বৃহৎ অর্থনীতি হিসাবে প্রথম। নোমিনাল হিসাবে দ্বিতীয়। বিশ্বের প্রায় সবদেশের কাঁচামালের প্রধান যোগানদাতা চীন। এমনকি ভারতের ক্ষেত্রেও। সমস্যা হল চীন যখন তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ অন্যদেশে বিনিয়োগ শুরু করল তখন। আগে সারাবিশ্বের দেশগুলির ঋন বা বিনিয়োগ সবকিছুর প্রধান নিয়ন্ত্রণ ছিল আমেরিকার হাতে। স্পেসিফিক বলতে গেলে আমেরিকা নিজে এসবের মধ্যে নেই। এতে ঝামেলা অনেক। এজন্য বিশ্বের গরীব দেশগুলির উপর শর্ত আরোপ সাপেক্ষে অর্থায়ন করতে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এর মত সংস্থার সৃষ্টি করেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে বিশ্ব ব্যাংক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু রাজিনৈতিক ভাবে আমেরিকা চাইছে না এমন কোন সিদ্ধান্ত নিলেই স্পষ্ট হয় বিশ্বব্যাংকের আসল রুপ। হ্যা। এটা সত্য বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন গরীব দেশের জন্য বেশ সাশ্রয়ী। সাধারনত মুনাফার হার ১.৫ শতাংশ নিচে থাকে। তবে এলডিসি থেকে উত্তোরনের পর ধীরে ধীরে এই হার বাড়তে থাকে। ব্যাবসাও শুরু হয়। তবে এটা মনে করার কোন মানে নেই যে বিশ্বব্যাংকের ১ শতাংশের সাশ্রয়ী ঋন পাওয়া খুব সহজ। এর জন্য আপনার দেশের সরকারকে ঋন পেতে অনেক শর্তের বাস্তবায়ন করতে হয়। না পারলে ঋন নেই।
একটা ছোট উদাহরন হল বাংলাদেশের আদমজী জুট মিল। বিশ্ব ব্যাংক যখন পাট খাতের ভবিষ্যত নেই বলে আদমজী বন্ধ করতে বলল ঠিক তখনি তারা ভারতে পাট খাতে বিশাল ঋন ছাড় করে। পরিনতি কি হল জানেন? বাংলাদেশ সারাবিশ্বে সোনালী পাট উৎপাদনে ছিল প্রথম। পাটজাত পণ্য উৎপাদনেও ছিল প্রথম। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলাদেশ সোনালী আঁশের একছত্র রাজত্ব হারিয়ে ফেলে। এখন এই দুটি শিরোপা আমাদের প্রতিবেশিদের হাতে।
আবার ধরুন অনেকক্ষেত্রে শর্ত দিবে এমন যে ঋন কৃষি খাতে ঋন দিবে কিন্তু দেশের বাজেটে কৃষিখাতে ভর্তুকি তুলে নেয়ার ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ বাতলে দিবে। অর্থাৎ একটি দেশের বাজেট প্রনোয়ন থেকে শুরু করে মুদ্রানীতি নির্ধারন, ফিসকাল পলিসি নির্ধারন সহ নানা ভাবে শর্ত থাকবে। শুধু এসব নয়। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন নীতি নির্ধারনে তাদের চাপ থাকে।
যেহেতু বিকল্প ফান্ডিং এর উৎস নেই তাই দেশগুলিকে বাধ্য হয়েই বিশ্ব ব্যাংকের ফান্ড পাবার আশায় অনেক কিছুই করতে হয়। আর একটি দেশের উপর বিশ্বব্যাংকের এই নিয়ন্ত্রণ পরোক্ষভাবে পশ্চিমা দেশগুলির নিয়ন্ত্রনের সামিল। সরাসরি আপনি আমেরিকা বা পশ্চিমা অন্য দেশকে দুষতে পারবেন না। দুষবেন বিশ্বব্যাংককে।
ভ্যাজাল শুরু দৃশ্যপটে যখন চীন উপস্থিত হল। মোটামুটি অভ্যন্তরীণ এসব নানাবিধ শর্ত বাদেই চীন আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলিতে ফান্ডিং করতে শুরু করল। চীনের ভুল হল চীন নিজেদের দেশের নাম ব্যাবহার করে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেল অবকাঠামো কাজগুলির ক্ষেত্রে চীনের প্রতিষ্ঠান কাজ পাচ্ছে। এতে বিশ্ব ব্যাংকের মনোনিত অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ পাবার সুযোগ আর পাচ্ছে না। চীনের ফান্ডিং এর বড় ঝুকি হল, ঋন বা বিনিয়োগ পাওয়া চীন এতটায় সহজ করেছে যে এর সুযোগ কিছু কিছু দেশ নিয়ে অপ্রয়োজনীয় খাতে ঋন নেয়া শুরু করেছে। তবে চীন জাত ব্যাবসায়ী। চীনের যেসব প্রতিষ্ঠান ঋন দিবে তাদের স্বার্থ চীন দেখে সবার আগে। তবে অর্থের উৎসে বিশ্বে বড় রকমের পরিবর্তনে পশ্চিমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রন চুড়ান্তভাবে খর্ব হয়। আর এর পর থেকেই পশ্চিমা মিডিয়া সারাবিশ্বে শুরু করে চীনা বিনিয়োগ বিরোধী প্রচারণা।
একটা উদাহরন দেয়া যাক। স¤প্রতি শ্রীলংকা দেউলিয়া ঘোষনার পর পুরো দোষ চাপানো হয়েছে চীনের ঘাড়ে। অথচ মিডিয়া প্রকাশ করেনি আসলে কি কারনে শ্রীলংকা এই পরিস্থিতিতে পড়ল। শ্রীলংকার মোট বিদেশি ঋনের ২০শতাংশ এর কাছাকাছি ঋন বিশ্বব্যাংক থেকে নেয়া। চীনের কাছে দেশটির ঋন ৪শতাংশ এর কম। শ্রীলংকা যে কারনে বড় রকমের ঝুকিতে পড়েছে সেটি হল সভেরেইন বন্ড ইস্যু করে। বন্ডের মাধ্যমে শ্রীলংকা ৯শতাংশ -১০শতাংশ রেটেও ঋন নিয়েছে। আর এই বন্ড সিস্টেমের বড় সমর্থক কিছু বিশ্ব ব্যাংক।
বাংলাদেশের উদাহরণ দিলে বিষয়টা কিছুটা পরিস্কার হবে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালে যখন অর্থায়নের চুক্তি করে তখন শর্তের বোঝা কম চাপায়নি। এরপর অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের একটা অংশ এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও বিভিন্ন ভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছিল ১৮০ কোটি ডলারের বন্ড ইস্যু করে টাকা সংগ্রহের। আর এক্ষেত্রে সুদের হার হত ৮শতাংশ থেকে ১০শতাংশ পর্যন্ত। ভাগ্যভাল যে আমরা সার্বভৌম বন্ডের প্যাড়ায় ঢুকিনি। এরপর বিদেশি উৎস থেকে অর্থ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু বিভাগ থেকে ১.২শতাংশ রেটে ৩৫ বছর মেয়াদের ঋন নেয়া হয়। এবার আগের প্রসঙ্গে আসি। চীনের লক্ষ্য প্রাচীন সিল্ক রোড চালু করে আবারো এশিয়ার দেশগুলির ভেতর বাণিজ্যিক অবকাঠামো শক্তিশালী করা। আর এটা করতেই তারা বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছে। চীনের এই বিনিয়োগকে ভীতিকর ভাবে উপস্থাপন করে বাংলাদেশ সহ অনেক দেশকেই সতর্ক করা হচ্ছে। এরকম মুহুর্তে আমার প্রশ্ন, বন্দর করলে, বা সড়ক অবকাঠামো শক্তিশালী করলে এত ভয় কেন? আতঙ্কিত কেন সারা বিশ্ব?
প্রশ্ন করাটা কি অস্বাভাবিক? আফ্রিকান দেশগুলির ডাইমন্ড সহ অন্যান্য খনিতে শ্রমিকদের খাটিয়ে পশ্চিমা দেশগুলি বড়লোক হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক খনির মালিকানা নিজ দেশে রাখার জন্য শর্ত দিয়েছে এরকমটা আমার জানা নেই। দেশগুলি গরীব। যুগের পর যুগ ধরে বিশ্বব্যাংকের এত এত সাহায্যের পরো দেশগুলিকি নিজেদের পায়ে দাড়াতে পেরেছে? এই দেশগুলি তাদের সড়ক বা অন্য অবকাঠামো বিনিয়োগ করলেই বিশ্ব ব্যাংকের অনীহা থাকে অর্থায়নে। এর কারন কি হতে পারে? এমন কি হওয়া সম্ভব যে এসব দেশ তাদের বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি পেলে এদের উপর নিয়ন্ত্রন কমে যাবে? অথবা যদি বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নত হয় তবে দেশটির ঋনের নিয়ন্ত্রন শুধু এবং শুধুমাত্র বিশ্ব ব্যাংকের হাতেই থাকবে? একটা সড়ক, বা বন্দর করলে এখানে সামরিক হুমকিটা আসলে কোথায়? এমনতোনা যে আমেরিকার যতগুলি মিলিটারি বেইজ আছে তার থেকে চীনের বেইজ বেশি। অথবা চীন সড়ক ও বন্দর করার সময় চুক্তি করে সেখানে মিলিটারি বেইজ বানিয়েছে।
আসল কথা হল, বিশ্ব বাণিজ্যে চীনের নিয়ন্ত্রণ এমন অবস্থানে রয়েছে যে এসব বন্দর বা সড়ক অবকাঠামো ব্যাবহার না করেই চীন চাইলে সাপ্লাই চেইন ভেঙ্গে দিতে পারে। চীন মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধে প্রমাণ হয়েছে যে মার্কিন কোম্পানিগুলি কতটা বিপদে পড়েছিল। এজন্য তো চীনকে বন্দর ব্যাবহার করতে হয়নি। হয়েছে কি? চীন যখন অওওই ব্যাংক গঠন করে তখনো পশ্চিমারা আতঙ্কিত হয়েছিল যে এটা হয়ত বিশ্বব্যাংকের প্রতিপক্ষ হবে। এরকম চিন্তার ভিত্তি কি সেটা বুঝতে রকেট সাইন্টিস্ট হওয়া জরুরি না। তাহলে অবকাঠামো বিনিয়োগে ভীতি ছড়ানোর পেছনে প্রকৃত অর্থে অন্য উদ্দেশ্য আছে কি? লেখাটার উদ্দেশ্য ছিল মুলত রাশিয়া, চীন ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সহজ বিশ্লেষন। লেখা ঘুরে অন্য দিকে চলে গেছে। পরবর্তী লেখায় এই টপিকে লিখব ইনশাল্লাহ।