
অর্থনীতি সমিতির ২১ লাখ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব
সোহেল রহমান : অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং সরকারের আয় বাড়াতে কালো টাকা ও পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে ২০ লাখ ৯৪ হাজার ১১২ কোটি টাকার বিকল্প জনগণতান্ত্রিক বাজেট প্রণয়নের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতি। প্রস্তাবিত বাজেটের এ আকার চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের ৩ গুণ এবং আসন্ন বাজেটের সম্ভাব্য আকারের প্রায় ২ দশমিক ৭ গুণ বড়।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি’র ইস্কাটন গার্ডেন রোডস্থ কার্যালয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২৩-২৪ : বৈষম্য নিরসনে জনগণতান্ত্রিক বাজেট’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত এ বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ও সুপারিশ তুলে ধরেন।
ড. আবুল বারকাত বলেন, আমাদের বাজেট স¤প্রসারণমূলক। সরকার আগামী অর্থবছরে যে বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তার আকার ৭ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে আমরা শুনেছি। সেক্ষেত্রে আমাদের বাজেট সরকারের চেয়ে ২ দশমিক ৭ গুণ বড়। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, লাগামহীন কর্মবাজার সংকোচন, মহামারি ও ইউরোপ যুদ্ধের অভিঘাত, এসব বিষয় মাথায় রেখে আগামী বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য বিপজ্জনক বৈষম্য কমানো। বিকল্প বাজেট বাস্তবায়ন করলে ১০ বছরের মধ্যে বিপজ্জনক বৈষম্য কমানো সম্ভব।
তিনি বলেন, দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বহুমাত্রিক দরিদ্র। ধনী ও অতি ধনীর সংখ্যা ১ শতাংশ। বহুমাত্রিক দরিদ্রের সংখ্যা কোভিডকালের চেয়েও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। অন্যদিকে প্রকৃত মজুরি না বাড়ায় জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। সঞ্চয় ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অনেকেই ধার-দেনা করে জীবন চালাচ্ছে, আমিষ জাতীয় খাবার তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছে। পূর্ণ কর্ম নিয়োজন, শিশুর জন্য সুস্থ জীবন, সবার জন্য আবাসন ও মূল্যস্ফীতি রোধ- এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে অর্থনীতি সমিতি বাজেট প্রণয়ন করেছে।
ড. বারকাত বলেন, বিকল্প বাজেটে কালো টাকা ও পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ উদ্ধারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে কালো টাকা ও অর্থ পাচার খাত। ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরে দেশে মোট কালো টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মাত্র ২ শতাংশ সরকারকে উদ্ধারের প্রস্তাব করেছি। এটা যদি উদ্ধার করা সম্ভব হয়, তাহলে সরকারের আয় হবে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭০ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মোট পরিমাণ হচ্ছে ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। যদি এ অর্থের মাত্র ৫ শতাংশ উদ্ধার করা যায় তাহলে সরকারের আয় হবে ৫৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কালো টাকা অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ায়। সম্পদকর আরোপ করলে বৈষম্য কমায়। ধনীদের কর কমালে প্রবৃদ্ধি বাড়ে না। নি¤œ ও মধ্যবিত্তের কর কমালে কর্মসংস্থান হয়।
বিকল্প বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৯ লাখ ২৯ হাজার ১১২ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪ দশমিক ৪২ গুন বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের মধ্যে আয়, মুনাফা ও মূলধনের ওপর কর অর্থাৎ আয়কর প্রস্তাব ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। দেশে কোটি টাকার বেশি আয়কর দেন ১০০ জনের মতো। আমাদের গবেষণা বলছে, ৪ লাখ ১৮ হাজার মানুষ কোটি টাকার ওপরে কর দেয়ার কথা। আর সম্পদকর নেয়া হয় না। এই খাতে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা আসা সম্ভব। ভ্যাট খাতে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা বর্তমান সরকারের বাজেটের মতোই। এই খাতে হাত দেইনি, কারণ ভ্যাট বৈষম্য হ্রাসে কোনো সহায়তা করে না। অন্যদিকে এনবিআর-বহির্ভূত কর যেমন- মাদক শুল্ক ১৫২ কোটি টাকা। যেখানে ৩০ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে এবং ভ‚মি রাজস্ব থেকে আসতে পারে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
তিনি বলেন, বিকল্প বাজেটের মধ্যে রাজস্ব আয় থেকে আসবে ১৯ লাখ ২৯ হাজার ১১২ কোটি টাকা। যা চলমান অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪.৪২ গুণ বেশি। অর্থ্যাৎ মোট বাজেটের ৯৩.২ শতাংশের যোগান দেয় রাজস্ব। বাকি ৭.৮ শতাংশ ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি হবে ঘাটতি বাজেট।
অধ্যাপক বারকাত বলেন, এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের মধ্যে আয়, মুনাফা ও মূলধনের ওপর কর অর্থ্যাৎ আয়কর প্রস্তাব ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। দেশে কোটি টাকার বেশি আয়কর দেন ১০০ জনের মতো। আমাদের গবেষণা বলছে, এই সংখ্যা ৪ লাখ ১৮ হাজার মানুষ কোটি টাকার ওপরে কর দেওয়ার কথা। আর সম্পদ কর নেওয়া হয় না। এই খাতে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা আসা সম্ভব। ভ্যাট খাতে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা বর্তমান সরকারের বাজেটের মতোই। এই খাতে হাত দেইনি, কারণ ভ্যাট বৈষম্য হ্রাসে কোনো সহায়তা করে না। অন্যদিকে এনবিআর-বহির্ভূত কর- যেমন মাদক শুল্ক ১৫২ কোটি টাকা। যেখানে ৩০ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে এবং ভ‚মি রাজস্ব থেকে আসতে পারে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
ড. বারকাত বলেন, বিকল্প বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও আমরা বিদেশি অর্থায়ন ও ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার পক্ষে নেই। বাজেট ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র, বন্ড, বিদেশে বসবাসরত নাগরিক ও কোম্পানি থেকে ঋণ নেয়ার কথা বলেছি।
আমেরিকার ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কার ভিসা প্রবলেম আমরা বুঝতে পারছি না। দেশে নি¤œবিত্ত ও নি¤œ-মধ্যবিত্তের সংখ্যা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ। এদের যুক্তরাষ্টের ভিসা দরকার নেই। ভিসা না দিলে কিংবা না-দিলেও এদের সমস্যা নেই। বরং এই শ্রেণির মানুষদের ভিসা পেলে সমস্যা, তাহলে যাওয়ার জন্য টাকা-পয়সা খুঁজবে। এটা নিয়ে রাজনৈতিক দলের লোকজন চিন্তা করবে।
সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৬৪টি জেলা, ১৩৫টি উপজেলা এবং ৪৫টি ইউনিয়ন থেকে সমিতির সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
