
প্রতিমাসে উৎপাদিত ভার্মি কম্পোস্ট সারের মূল্য ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা

মো. আখতারুজ্জামান : দেশের বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ১২২টি কেচোঁ কম্পোস্ট (ভার্মি কম্পোস্ট) প্রদর্শনী প্লট তৈরি করা হয়েছে। এসকল প্রদশ্রনী প্লট হতে প্রতিমাসে ২ হাজার ৪০০ টন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিকেজি ভার্মি কম্পোস্ট সার ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় হচ্ছে, যার মোট মূল্য ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) সূত্রে জানা যায়, পিকেএসএফ, ইফাদ ও ডানিডার অর্থায়নে ক্ষুদ্র উদ্যোগ খাতের অধিকতর বিকাশের লক্ষ্যে রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট (আরএমটিপি) শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে এসব প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে।
মূলত গোবর থেকে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির মাধ্যমে উদ্যোক্তারা একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে, অন্যদিকে তারা ভার্মি কম্পোস্ট সারের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে জৈবসার এর যোগান নিশ্চিত করছে।
এই ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তেমনি আতœনির্ভশীল হচ্ছে অনেকে।
এই সার উৎপাদনকারি এমই এক সফল উদ্যোক্তা বগুড়ার শাহাজানপুরের সুরাইয়া ফারহানা রেশমা। একসময় রেশমার দিনগুলো আজকের মতো ছিল না। রেশমার বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সে, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়। বিবাহিত জীবনেও তাকে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছে। আমার স্বামী নেশা করতেন, জুয়া খেলতেন।
রেশমা ফেসবুকে পেজ খুলেছেন রেশমা কৃষি উদ্যোগ নামে। ভার্মি কম্পোস্ট নাম দিয়ে কেঁচো সারের বস্তা বিক্রি করেন তিনি। নিজের ও খামারের নামে ভিজিটিং কার্ডও আছে। রেশমা বললেন, মা তার মায়ের (রেশমার নানি) কাছ থেকে যে জায়গা-জমি পেয়েছিলেন, তা রেশমার নামে লিখে দিয়েছেন। সেই জায়গা ও পরে আরও জমি কিনে রেশমা তার উদ্যোগের পরিধি বাড়িয়ে চলেছেন।
২০১৪ সালে তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে বিনা মূল্যে গরু মোটাতাজাকরণ, মাছ চাষ, সেলাইসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। অধিদপ্তর থেকে প্রথমে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এরপর ৭৫ হাজার ও ১ লাখ টাকা ঋণ নেন এবং পরিশোধও করেন। ছোট পরিসরে খামার শুরু করেন ২০১৪ সালের শেষ দিকে।
রেশমা বললেন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কাছ থেকে নেওয়া ৫০ হাজার টাকা, মায়ের কাছ থেকে নেওয়া টাকা, নিজের জমানো টাকাসহ মোট ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু আর ছাগল কেনেন। তারপর কেঁচো সার নিয়ে কাজ শুরু করেন। এভাবে আস্তে আস্তে উদ্যোগের পরিসর বাড়তে থাকে। বর্তমানে তার খামারে শ্রমিকদের প্রতি মাসে বেতন ৬ থেকে ১২ হাজার টাকা। নিজের খামারের বর্ণনা দিতে গিয়ে রেশমা বলেন, খামারে কেঁচো সার তৈরির জন্য এখন রিংয়ের সংখ্যা ২০০। প্রতি মাসে একেকটি রিং থেকে প্রায় ৩৫ কেজি সার পান। ফলের ঝুঁড়িতেও সার তৈরি করছেন। একেকটা ঝুড়ি থেকে মাসে ১৪ কেজি সার পাওয়া যায়। ঝুড়ির সংখ্যা ২০০টির বেশি। হাউস বা চৌবাচ্চা পদ্ধতিতেও সার তৈরি করছেন। একেকটি চৌবাচ্চায় ২০০ কেজি পর্যন্ত সার পাওয়া যায়। এমন চৌবাচ্চা আছে ৬৫টি। এছাড়াও তিনি আরএমটিপি প্রকল্প হতে গাক এর মাধ্যমে নতুন করে অনুদান পান এবং কম্পোস্ট ঝুরি করার জন্য মেশিন পান। যা তার কাজকে আরো সহজ করেছে। বর্তমানে রেশমা প্রতি মাসে প্রায় ৩০ টন ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করেন। যার বাজার মূল্য ৩ লাখ টাকা। এসব কেঁচো সার বাড়ি থেকে পাইকারি ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। অনলাইনে সর্বোচ্চ ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। রেশমার খামারে গরু আছে ২৫টি। ৬টি গাভি দিনে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি লিটার দুধ দেয়। দুধ বিক্রি করেন ৫০ টাকা কেজি দরে। ছাগল আছে ১৫টি। হাঁস ১২০টি। দেশি মুরগি ২০০টির বেশি। কবুতর, পুকুরের মাছ ও নিরাপদ সবজি তো আছেই। জমিতে ধান চাষও হচ্ছে। গরুর মাংস ছাড়া রেশমাদের বাইরে থেকে তেমন কিছুই কিনতে হয় না। বাড়িসহ তাদের মোট জমির পরিমাণ ছয় বিঘা। রেশমা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) নিবন্ধন করেছেন। তার ট্রেড লাইসেন্স আছে। এবার তিনি করও দেবেন। ফেসবুক পেজে রেশমার কার্যক্রম দেখে ৪০ জেলার ৪০০ জন তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাড়িতেই এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছেন রেশমা। প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে এক হাজার করে টাকা নেন রেশমা। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা, খাতা-কলম দেওয়াসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেন তিনি। জানালেন, প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর পেছনে এক হাজার টাকার বেশি খরচ হয় তার। রেশমার ভাষায়, সব জায়গায় তো আর ব্যবসা করা যায় না।
