বাজেট ঘাটতি না কমালে চাপ আরও বাড়বে ডলারে : জাহিদ হোসেন
আব্দুর রহিম : এক বছর ধরেই ডলার সংকটে নাকাল বাংলাদেশ নতুন অর্থ বছরের বাজেটের প্রভাবে সেই পরিস্থিতি যেন আরও নাজুক না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে বললেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তার মতে, বাজেট ঘাটতি বাড়ার ফল হিসেবে বাড়বে ডলারের উপর চাপ। আর তা মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের আগে এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ।
বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করবেন, তার আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে বলে আভাস পাওয়া গেছে। বর্তমান অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার, যদিও তা সংশোধন করে ৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। জাহিদ হোসেন বলেন, সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার যে বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, তাতে ঘাটতি অর্থায়নই থাকছে ২ লাখ কোটি টাকার উপরে, যা আগের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। তিনি বলেন, ঘাটতি বাজেট ডলার সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেবে। কারণ ডলার তো আসছে না। চাহিদাজনিত কারণেই টাকার মান কমে যাবে। তখন মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বাড়বে। ডলার সংকট কাটাতে বাজেটে সরাসরি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে লাগাম টানা এবং আমদানিনির্ভর প্রকল্প আপাতত বাদ দেওয়া অথবা ধীর বাস্তবায়ন নীতিতে চলার পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, বিদেশি অর্থায়ন না হওয়ায় ডলার আসছে না। তাই ব্যয় সাশ্রয় এবং ঘাটতি কমিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব প্রকল্প দেশীয় অর্থায়নে চলবে, কিন্তু প্রকল্পের নির্মাণ বা উপাদান সামগ্রী হিসেবে মেশিনারি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আমদানি করতে হবে, সেসব প্রকল্পও এড়িয়ে চলতে হবে। পাইপলাইনে বিদেশি বিনিয়োগ ও ঋণ রয়েছে তা দ্রæত ছাড়ের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন,যদি দক্ষতা বৃদ্ধি ও জবাবদিহিতা আনা যায়, তাহলে সরকার ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো পেতে পারে এখান থেকে। এটি ডলার সংকটকে অনেকটা কাটিয়ে দিতে পারে। ডলার আয়ের একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে তিনি দেখালেন আন্তর্জাতিক অনলাইন শ্রমবাজারকে। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে বসেই যুবকদের একটি অংশ এখন বিদেশ থেকে ডলার আনছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, ওয়ার্ক ভিসা ছাড়াই বিদেশে না গিয়েই শহুরে শিক্ষিত তরুণ গোষ্ঠীর একটি অংশ এ বাজার থেকে আয় করছে। বর্তমানে এ বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। গ্রামে থাকা ও কম্পিউটার না থাকাদের ইংরেজি ভাষা, টেকনোলজির জ্ঞান ও আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে আরেকটু সহযোগিতা করা গেলে এ খাত থেকে আয় বাড়ানো যাবে। কারণ এ সুবিধা এখন আর্থিক সামর্থ্যবানরা পাচ্ছেন। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এ সুযোগটি নিতে সরকার এ খাতে মনোযোগী হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঘাটতি কমানোর পথ কী?
বাজেট ঘাটতি কীভাবে কমানো যেতে পারে, তার কিছু উপায় বাতলে দেন জাহিদ হোসেন। বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে রাজস্ব আদায় বাড়ানো। কিন্তু সেদিকে কোনো সুখবর দেখছেন না বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এবারের রাজস্ব আদায় চিত্র খুবই খারাপ (৯ মাসে আদায় লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬১%)। আইএমএফের শর্ত পূরণে নতুন করে আরও ৮০-৯০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে সরকারকে। এটি কোথায় পাবে এনবিআর?
ভর্তুকি ব্যয় কমাতে পারছে না সরকার। তাহলে এত টাকা গেল কোথায়- প্রশ্নটি এখন উঠছে।
একটি উপায় হতে পারে, সরকার প্রতি বছর কর ছাড় হিসেবে আড়াই লাখ কোটি টাকার সুবিধা দিচ্ছে বিভিন্ন খাতে। এর মধ্যে কিছু সুবিধা আগ থেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা। যার মেয়াদ এবছরও কিছু শেষ হবে। এগুলো যদি আর না বাড়ানো হয়, আর পরবর্তীতে ধাপে ধাপে সুবিধার মেয়াদ শেষ হলেই তা বন্ধ করে দেওয়া। সব মিলিয়ে এখাত থেকে সর্বোচ্চ ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে ধারণা দেন তিনি। তবে পরামর্শ দিলেও তিনি সন্দিহান সরকার তা পারবে কি না- বিভিন্ন প্রেশার গ্রæপের কারণে হয়ত সরকার তা পেরে উঠবে বলে মনে হয় না। এনবিআরের রাজস্ব আদায়কে পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ বা সরাসরি কর ব্যবস্থায় নিয়ে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন জাহিদ হোসেন। এজন্য কর কাঠামো ও রাজস্ব আদায় পদ্ধতি আরও স্বচ্ছ এবং ডিজিটাইলাইজেশনে জো দিয়ে তিনি বলেন, কর নির্ধারণ, পুনঃযাচাই, বিরোধ নিস্পত্তি, আপত্তিসহ যাবতীয় কাজ অটোমেশনে নিয়ে যেতে হবে। যাতে কর দাতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ না হয়। দেখা হলেই সমস্যা। কর জিডিপি অনুপাত আইএমএফের পরামর্শে যে ০.৫ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলেছে, তা খুবই চ্যালেঞ্জের। আশা করি, আগামী বাজেটে এনবিআরকে সুর্নিদিষ্ট কিছু লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দিবেন অর্থমন্ত্রী, বলেন তিনি। বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্র হিসেবে ভর্তুকি কমিয়ে আনার পথও দেখান জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, সরকার জ্বালানিতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে মূল্য বৃদ্ধি করল একাধিকবার। তারপরও তো ভর্তুকি ব্যয় কমাতে পারছে না সরকার। তাহলে এত টাকা গেল কোথায়- প্রশ্নটি এখন উঠছে।
তেল, গ্যাস সরবরাহকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি। ৫-৮ বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া ও বিদ্যুৎ ক্রয় করায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ পুরোটাই উঠে গিয়েছে। তারা মুনাফাও করেছে। এখন তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ। রপ্তানি পর্যায়ে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তা কমাতেও নজর দেওয়ার পরামর্শ আসে এই অর্থনীতিবিদের কাছ থেকে। সবগুলো খাতই প্রকৃত অর্থে রপ্তানি বৃদ্ধি করছে না। এক নামের পণ্য আরেক নামে যাচ্ছে শুধু রপ্তানি ভর্তুকি পেতে। রেমিটেন্সে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে যাওয়া নিয়েও আপত্তি তোলেন তিনি। রেমিটেন্সের বিপরীতে দেওয়া আড়াই শতাংশ প্রণোদনাও খুব একটা কাজে লাগছে না। প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আসা বাড়ছে না। এসব ভর্তুকি বন্ধ করলে ৫-৬ হাজার কোটি টাকা সরকারের ঘাটতি থেকে কমে যাবে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।
নইলে মূল্যস্ফীতি চড়বে?
ডলার সংকটের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারকে সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন বিশ্ব ব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার কমানোর লক্ষ্য করছি ৬ শতাংশে নামানো। এর মানে হচ্ছে বাজেট স¤প্রসারণমূলক হবে। তাহলে ঘাটতি বাড়িয়ে কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক খাত ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বিদেশি উৎস থেকে এক-তৃতীয়াংশ এবং বাকিটা দেশীয় উৎস থেকে আসবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যে ঋণ নেওয়া হবে, তা কি বাংলাদেশ ব্যাংক দেবে, না বাণিজ্যিক ব্যাংক দেবে, সেই প্রশ্নের সুরাহা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক।
তার মতে, যদি অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ সংগ্রহ হয়, তা যেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে না করা হয়। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৭০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাপিয়েছে এ ঋণ দিতে গিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে টাকা ছাপায় তা হাইপাওয়ারড মানি, এতে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমানেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। আগামী বাজেটে তা ৬ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনা করছে বলে সংবাদপত্রের মাধ্য্যমে জানতে পারছি। এটা কীভাবে সম্ভব? যেখানে সরকার টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিচ্ছে। যদি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিত, তা মূল্যস্ফীতিকে খুব একটা চাপ দিত না, কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগে একটু সমস্যা দেখা দেবে।
প্রবৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে কারা?
সরকার আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ ধরছে।
অর্থনীতিতে ডলার সংকট, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে পণ্য সরবরাহ কমিয়ে আনা ও বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে এ প্রবৃদ্ধি অর্জন কতটা সম্ভব? জাহিদ হোসেন বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতি কমবে, এটি তখনই সম্ভব, যখন সরবরাহ বাড়বে, কিন্তু চাহিদা কমে যাবে। কিন্তু এখন আমরা দেখছি জ্বালানিসহ অনেক পণ্যই আমদানি করতে পারছি না, কিন্তু চাহিদা তো রয়েছে। আবার ডলার সংকটে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনৈতিক কর্মকাÐর পরিধি কমিয়ে আনা হচ্ছে। এভাবে কঠিন হবে জিডিপি প্রবৃদিধ লক্ষ্য অর্জন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেওয়া উৎপাদন খাতে কেন কর্মসংস্থান বাড়ছে না? তাহলে প্রবৃদ্ধির সুবিধা কারা পাচ্ছে?
আয় বৈষম্য বাড়ার দিকটি দেখিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থান বাড়ছে না শিল্প খাতে। বড় শিল্পে নারী কর্ম সংস্থানও কমেছে। উন্নয়ন ইতিহাস বলে, প্রবৃদ্ধি বাড়লে শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়বে, কৃষিতে কমে যাবে। কিন্তু আমাদের এখানে ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। কৃষিতে কর্মসংস্থান বাড়ছে। আমাদের এখন দেখতে হবে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেওয়া উৎপাদন খাতে কেন কর্মসংস্থান বাড়ছে না? তাহলে প্রবৃদ্ধির সুবিধা কারা পাচ্ছে? শোভন কর্মসংসস্থানের খাত তো শিল্প থেকেই আসবে। আমরা যদি শোভন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারি, তাহলে তো বিদেশে যাওয়ার পরিমাণ বাড়বেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের (এডিপি) গতি নিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর দেখছি, সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণসহ যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালকের জবাবদিহি না থাকায় বাস্তবায়নের হার সেভাবে এগোচ্ছে না। এজন্য আমলাদের পদোন্নতি দিতে এসব বিবেচনায় নিতে হবে। সরকারি কাজের তদারকিতে স্থানীয় জনগণকেও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সূত্র : বিডিনিউজ