বাজেট প্রতিক্রিয়া সুযোগ সুবিধা দিলে আমরা বিনিয়োগ বাড়াবো : বিজিএমইএ
মো. আখতারুজ্জামান : তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাজেটে আমাদের সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। আর সুযোগ সুবিধা দিলে আমরা আমাদের বিনিয়োগ বাড়াবো। গতকাল শুক্রবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের এই খাতে বর্তমানে গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা প্রকট। অনেক কারখানা উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেকে অর্ডারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বর্তমানে কারখানার মেসিনারিজ আমদানি করতে পারছি না। কাঁচামাল চাহিদা অনুযাই আমদানি করতে পারছি না। ব্যাংকের সুদহার তুলে দেয়া হলে আমাদের ব্যয় বেড়ে যাবে বলেও জানান সভাপতি।
তিনি বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের পথে প্রথম বাজেট এটি। এর মধ্য দিয়ে ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে স্মার্ট যুগে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। এজন্য অর্থমন্ত্রীকে জানিয়ে তিনি বলেন, এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা ও রাজস্ব বাড়ানো, যা আমাদের বাজেটের ইতিবাচক দিক। ফারুক বলেন, লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো বর্তমান সংকটকালীন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যখন কিনা সা¤প্রতিক রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের নি¤œমুখী ধারা স্পষ্ট দৃশ্যমান, তখন সরকার আগামী অর্থবছরে ৭.৫% প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ঘোষনা দিয়েছে, যা এই কঠিন সময়ে জাতির মনে আশার সঞ্চার করেছে। শিল্পের প্রবৃদ্ধি ছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়, যেহেতু জিডিপি’র প্রায় ৩৫.৬% আসে শিল্প খাত থেকে, যা ২০৪১ সাল নাগাদ ৪০% এ উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। শিল্পের সকল সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে লাগানো গেলে কাঙ্খিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতা বাড়িয়ে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে এই নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় পোশাক শ্রমিকদের অন্তভর্‚ক্ত করার বিষয়টি আমাদের প্রত্যাশা ছিল। দেশের রপ্তানী আয় ও জিডিপি’তে যারা সরাসরি অবদান রাখছেন সেই সব শ্রমিক ভাই-বোনদের উন্নত নাগরিক সেবা প্রাপ্তি পক্ষান্তরে শিল্প ও অর্থনীতিকেই লাভবান করবে। তাই সামাজিক সুরক্ষা খাতে পোশাক শ্রমিকদের অন্তভর্‚ক্ত করা প্রয়োজন। এই নেতা বলেন, পোশাকখাত বরাবরই সরকারের সহায়তা পেয়ে আসছে, তা না হলে আমরা এত প্রতিকুলতা পারি দিয়ে আজকের এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না। এই খাতে কর্মরত শ্রমিকদের বিষয়ে তিনি সব সময়ই সহানুভুতিশীল। তারই বিজ্ঞ দিকনির্দেশনার কল্যানে আমরা কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এখনও টিকে আছি। লেখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আমদানি ও রপ্তানিতে ব্যবহৃত কনটেইনার আমদানিতে করভার কমিয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কৃত্রিম আঁশের তৈরি কাটা ফেব্রিক্স এবং নষ্ট টুকরা (এক মিটারের বেশি দীর্ঘ নয়); বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেষ্টিং ইনস্টিটিউশন এর নিকট নমুনা হিসেবে বিনামূল্যে সরবরাহকৃত ফেব্রিক্স (তিন বর্গমিটারের নীচের আকৃতির) এবং উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্পকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে নতুন এইচ এস কোড সংশ্লিষ্ট কতিপয় যন্ত্রাংশ সংযোজন এবং কিছু পণ্যের বর্ণনা সংশোধনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রজ্ঞাপনটি সংশোধন করা হয়েছে।
রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের বিকাশের জন্য রপ্তানি প্রণোদনা, কর অব্যাহতি, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা ইত্যাদি প্রদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিভিন্ন রপ্তানিমুখী তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ও পরিবেশ বান্ধব শিল্প স্থাপনকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য স্থানীয়ভাবে বিদেশী বাণিজ্যিক অফিস স্থাপন, বিদেশী কর্মীদের ভিসা সুপারিশ ও কর্মানুমতি প্রদানের কর্মপদ্ধতি ২০২৩ অনুমোদন করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্য কাস্টমস অফিস স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
ফারুক হাসান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩টি পেট্রোলিয়ামজাত পন্যের উপর ১৫% মূসক সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। স¤প্রতি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। আমরা মনেকরি এর ফলে জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেই সাথে আমরা দাবী করব যেন আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সংগতি রেখে সবধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনা হয়। পাশাপাশি এলএনজি ও এলপিজি’র আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাচ্ছি। এটি করা হলে একদিকে আমাদের শিল্পে উৎপাদন খরচ কমবে, আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়বে, অন্যদিকে মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার যে লক্ষ্য নির্ধারন করেছে সেটি অর্জন সহজ হবে। পাশাপাশি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই যে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেলেও নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহের জায়গাটিতে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। আমাদের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সব ধরনের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে এবং এই অসাধু কর্মকান্ডের পেছনে লাইনম্যান, মিটার রিডার ও ভোক্তা, যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদেরকে যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণায় আমরা রপ্তানিমূখী বস্ত্র ও তৈরি পোশাকখাতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন দিক নির্দেশনা খুঁজে পাইনি। বিশেষকরে আমরা উৎসে কর কমানোর প্রস্তাব না করে ২০২১-২২ অর্থবছরের যেটি ছিল, অর্থাৎ ০.৫০% করার জন্য প্রস্তাব করেছিলাম। কারন এমনিতেই কোভিডের কারনে আমাদের শিল্পে যে ক্ষতি হয়ে গেছে সেটি পুষিয়ে নিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি, তার উপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে একদিকে বিশ্বেব্যাপী মন্দা চলছে, খুচরা বিক্রয় চাহিদা কমে এসেছে, অন্যদিকে জ্বালানি তেল সহ সবকাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের রপ্তানি আয় কমতে শুরু করেছে, তবে ফেব্রæয়ারী মাস পর্যন্ত আমাদের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সেটিও এই উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে ইউনিট ভ্যালু বেড়ে যাওয়ায় কারনে হয়েছে।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের ফলে আমাদের পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। অনেক কারখানা আন্ডার ক্যাপাসিটিতে চলছে, আগামী মাসগুলোতে আমরা এই অবস্থা উত্তরনের কোন লক্ষণ দেখছি না। এর উপর পহেলা জুলাই থেকে ব্যাংক সুদের যে ক্যাপ নির্ধারিত ছিল তা তুলে দেয়া হচ্ছে। এর ফলে আমাদের ব্যয় আরও বাড়বে। আমরা প্রতিযোগী সক্ষমতা হারাব। আমাদের পোশাকের প্রধান দুই বাজার আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে ঋণের সুদের হার অনেক বেড়েছে; মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমেছে।
সভাপতি বলেন, আমাদের পোশাক রপ্তানির অন্যতম বৃহৎ বাজার, ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি অফিসিয়ালি জানিয়ে দিয়েছে, দেশটি মন্দার কবলে পড়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর অবস্থাও ক্রমশ সঙ্গীন হচ্ছে। চলমান সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে উৎসে কর ২০২১-২২ অর্থবছরের ন্যয় ০.৫০% ধার্য করে আগামী ৫ বছর পর্যন্ত তা কার্যকর করার জন্য পুনরায় সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এই নেতা বলেন, আমরা নগদ সহায়তার উপর আরোপকৃত ১০% কর প্রতাহারের অনুরোধ জানিয়েছিলাম, যেহেতু নগদ সহায়তা কোন ব্যবসায়িক আয় নয়, তাই নগদ সহায়তার অর্থকে করের আওতার বাইরে রাখাই যুক্তিসংগত। আমরা মনে করি, এই সংকটময় সময়ে এটি একটি গুরুত্বপুর্ন সহায়তা হবে। নগদ সহায়তা যেহেতু কোন ব্যবসায়িক আয নয়, তাই নগদ সহায়তার অর্থকে করের আওতার বাইরে রাখাই যুক্তিযুক্ত। নগদ সহায়তার উপর আরোপকৃত ১০% কর প্রতাহারের অনুরোধ জানাচ্ছি।
এছাড়াও আরও যে বিষয়গুলোর উপর আমরা প্রস্তাব করেছিলাম, তার মধ্যে গুরুত্বপুর্ন কিছু প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছিঃ-
তৈরি পোশাক শিল্পের অংংবংংসবহঃ এর সময় কর আরোপকালে অন্যান্য আয়, বিবিধ খরচকে অগ্রহনযোগ্য হিসেবে গণ্য করে স্বাভাবিক হারে (৩০%) কর আরোপ না করে কর্পোরেট কর হার ১২% হারে আরোপ করা।
রপ্তানি বাণিজ্যের বৃহত্তর স্বার্থে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানিকারকদের থেকে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য পরিশোধিত ফি হতে উৎসে আয়কর কর্তনের হার ২০% হতে হ্রাস করে ১০% করা। আমরা কৃতজ্ঞ যে সরকার ইমপোর্ট রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট (আইআরসি) এবং এক্সপোর্ট রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট (ইআরসি) নবায়নের মেযাদ এক বছর থেকে বৃদ্ধি করে পাঁচ বছর করেছে। ফলে রপ্তানিকারকদের সময় সাশ্রয় ও ব্যয় হ্রাস পেয়েছে।