টিন ধারীদের বাধ্যতামূলক ২০০০ টাকা করলে মানুষের মধ্যে ভয় বাড়বে
মো. আখতারুজ্জামান : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রস্তাবিত বাজেটে প্রত্যেক টিন ধারীদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক ২০০০ টাকা করে কর নেয়ার প্রস্তাব করেছে। এই আইন নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এটা হবে মানুষের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেয়ার আইন। এই আইন না করে ট্যাক্স কর্মকর্তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের যে ভিতি রয়েছে সেটা দূর করে সেবার মান বাড়ালে ট্যাক্স আদায়ের পরিমাণ বাড়বে বলেও জানান তারা।
এবিষয়ে বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, ২ হাজার টাকা বড় বিষয় নয়। বিষয়টা হচ্ছে ট্যাক্স আইনের। কারণ যাদের প্রকৃত আয় থাকবে তাকেই ট্যাক্স দিতে হবে। যার আয় নেই সে কিভাবে ট্যাক্স দিবে। আর কেনই বা ট্যাক্স দিবে। এই আইন হলে সেটা হবে মানুষের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেয়ার আইন। এটা সমর্থন যোগ্য নয়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক সিনিয়র এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যেখানে মানুষ ব্যক্তি আয়কর জমা দিতে আইনজীবীর কাছে যায়, সেখানে এই আইন করলে ভয়ের জায়গাটা আরও বড় হবে। এসব না করে, যাদের ট্যাক্স দেয়ার সামর্থ আছে কিন্তু ট্যাক্স দেয় না তাদেরকে ট্যাক্সের আওতায় নিয়ে আসা। অনেক টিন ধারী আছেন, যারা ভয়ে আয়কার জমা দেন না। তাদেরকে ভয় ভেঙ্গে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। টেক্স কর্মকর্তাদের সাধারণ মানুষ ভয় পায়। এই জায়গাটায় কাজ করে সেবার মান বাড়ালে সব থেকে ভালো হবে। অন্যথায় ২ হাজার টাকা আদায়ের আইন করলে মানুষের মাঝে ভয়ের জায়গাটা আরও বড় হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইনুল ইসলাম জানান, যাদের আয় নেই তারা যদি টিন ধারী হয়, তাহলে তারা কিভাবে এই টাকা দিবে? যদিও টিন বাতিলের সুযোগ রয়েছে। আর বর্তমানে এনবিআরের যে লোকবল রয়েছে তা দিয়ে এই বিশাল সংখ্যক টিন ধারীদেরকে সেবা দেয়া অসম্ভব। সব মিলে এটা নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীবিদ বলেন, এনবিআর যদি ৩য় পক্ষকে দিয়ে ট্যাক্স আদায়ের কাজ করান, তাহলে সেটা আরও জটিল হবে। অনিয়মে জড়িয়ে পড়বে ৩য় পক্ষ্যের লোকজন, যা হবে হিতে বিপরীত।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, নতুন আইনে অবাস্তব কিছু বিধান যুক্ত করে ট্যাক্স আইনটাকে দুর্বল করা হচ্ছে। এই আইন ব্যবসায়ীদের মনে আরও ভিতির সঞ্চয় তৈরি করবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যক্তি কর দিতে হয় আইনজীবীর মাধ্যমে। তা না হলে যে রিটার্নার জমা দিবে তাকে নানাভাবে হয়নারির শিকার হতে হয়। ট্যাক্স কর্মকর্তাদের সাধারণ মানুষ যাতে ভয় না করে সেই ব্যবস্থা করলে তারা নিজেই সেচ্ছায় কর দিবে বলেও জানা তিনি।
তবে গত ৭ জনু বাজেট পরবর্তী এক আলোচনা সভায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, টিন নম্বর থাকলে ২০০০ টাকা কর দেওয়ার নতুন প্রস্তাবনাকে অসুবিধা হবে না। দেশে ছয় কোটি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। সুতরাং ২০০০ টাকা দিতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। আমরা ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছি বলেও তিনি জানান।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, টিআইএনের বিপরীতে দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর আদায়ের প্রস্তাবটিকে কেউ কেউ বৈষম্যমূলক বললেও এ নিয়মে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে না। যাদের ক্ষেত্রে টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক, সেই শ্রেণির মানুষদের জন্য এই ন্যূনতম কর বোঝা হওয়ার কথা নয় বলেও তিনি জানান।
বর্তমানে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাতিল বা স্থগিত করার সুযোগ নেই। ১২ সংখ্যার টিআইএন থাকলে অবশ্যই বছর শেষে আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত জানিয়ে বার্ষিক রিটার্ন জমা দিতে হয়। করদাতার যদি রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা না থাকে বা পরপর তিন বছর করযোগ্য আয় না থাকে বা শারীরিক অক্ষমতার কারণে ভবিষ্যতে করযোগ্য আয় শূন্য থাকে, তাহলে তিনি টিআইএন বাতিলের আবেদন করতে পারবেন। কেউ মারা গেলে, স্থায়ীভাবে দেশ ত্যাগ করলে, একাধিক নিবন্ধন (টিআইএন) বা ভুলবশত নিবন্ধন পেতে থাকলে, আইনি মর্যাদা পরিবর্তন করলে, অন্য কোনো আইনানুগ কারণ থাকলে নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। করদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কর বকেয়া না থাকলে বা আয়কর-সংক্রান্ত কোনো বিরোধ না থাকলে রাজস্ব বোর্ড টিআইএন বাতিল করে দেবে।
নতুন আয়কর আইনে করদাতার ছয় বছর আগের যেকোনো সময়ের সম্পদ উদঘাটন হলে তার ওপর আয়কর ধার্য করার বিধান রাখা হয়েছে। ফলে সম্পদ লুকিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কমে যাবে।
আয়কর আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, দেশে অবস্থানরত বিদেশিদের বাংলাদেশে তাদের সম্পদ ও দায় ট্যাক্স রিটার্নে দেখাতে হবে। স্বামী বা স্ত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের যদি টিন নম্বর না থাকে, সেক্ষেত্রে পরিবারের করদাতাকে তাদের সম্পদ ও দায়ের বিবরণী দাখিল করতে হবে।
বাংলায় খসড়া করা নতুন আয়কর আইন ১৯২২ সালের আয়কর আইন সংশোধন করে প্রণয়ন করা বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর স্থলাভিষিক্ত হবে। আইনটিতে কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে হিসাব পদ্ধতি, অবমূল্যায়ন ও মর্টাইজেশন বিধিমালা, মূলধন লাভ সম্পর্কিত বিধান, অদৃশ্য সম্পদ থেকে আয়, স্থানান্তর মূল্য ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।