মন্ত্রিসভায় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০২৩ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ের একটি নম্বর
সোহেল রহমান : ২০০৬ সাল থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি ও সরবরাহের কাজ ছিল নির্বাচন কমিশনের অধীনে। এখন এই দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে দিতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নতুন এই আইন সংসদে পাসের পর কার্যকর হলে নাগরিকদের পরিচয়ের একটিই নম্বর থাকবে; যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে জন্মের পরেই দেয়া হবে। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ আইন অনুমোদন দেয়া হয়। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, আইনের অধীনে একটি নিবন্ধক অফিস থাকবে। তারা জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের কাজ করবে। খসড়া অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় নিবন্ধকের কার্যালয় থাকবে। তিনি বলেন, তবে ঠিক কবে নাগাদ এটা আইনে পরিণত হবে, সেটা আমি জানি না। তবে আমরা চাই দেশের সকল নাগরিকের একটাই নম্বর থাকুক। আমরা সে দিকেই যাচ্ছি। প্রসঙ্গত- জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দিতে নিবন্ধন আইনের খসড়া এক বছর আগেই মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। প্রায় এক বছর পর এসে খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেলো।
সাধারণত কোনও আইন সংসদে পাস হলেই কার্যকর হয়। তবে এ আইনের বেলায় তা হবে না বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, এ আইনটি সংসদে পাস হলেও এখনই কার্যকর হবে না। সরকার যখন মনে করবে, তখন সিদ্ধান্ত জানালে এই আইন কার্যকর হবে। এ আইন কার্যকর হলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এনআইডি সংক্রান্ত দায়িত্ব হবে শুধু ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। নাগরিকের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে তারা তাকে ভোটার তালিকায় যুক্ত করবেন। আর নাগরিকরা জন্মের পরপরই নিবন্ধন করে ফেলতে পারবে; যা করতে হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।
জানা যায়, এনআইডি সেবার দায়িত্ব থেকে নির্বাচন কমিশনকে বাদ দেয়ার চিন্তা আগে থেকেই ছিল সরকারের। এক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি ছিল, শুধু ভোটার নয়, এনআইডি হবে দেশের সব নাগরিকের জন্য। এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তাসহ আরও অনেক কাজে এনআইডি’র ব্যবহার বাড়াতে চায় সরকার। ২০২১ সালের ১৭ মে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম ইসির পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্ত করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এক সপ্তাহ পর ২৪ মে ইসি সচিব ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ সচিবের কাছে চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সুরক্ষা সেবা বিভাগ উক্ত দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। এনআইডি নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
ওই চিঠিতে সুরক্ষা সেবা বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ‘রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬’ এর রুল ১০ অনুসরণে এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০১০’ এ ‘নির্বাচন কমিশন’র পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দ অন্তর্ভুক্তকরণসহ প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এছাড়া সুরক্ষা সেবা বিভাগের এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়।
একই বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের ৮ জুন জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নিজেদের কাছে রাখার বিষয়ে অবস্থান তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয় ইসি। চিঠিতে কমিশন জানায়, এনআইডির কাজ অন্য বিভাগে গেলে ভোটার তালিকা করা ও তা হালনাগাদ এবং নির্বাচনসহ বিভিন্ন সমস্যা হবে। এছাড়া যে কাজটি কমিশন করছে সেটি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর হলে নতুন জনবল ও অবকাঠামো প্রয়োজন হবে। এতে খরচ হবে সরকারের কোটি কোটি টাকা। এছাড়া ভোটার আইডি কার্ড করতে গিয়ে কমিশন নাগরিকদের ৩২ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে। ফলে এনআইডি সেবা কার্যক্রম কমিশনের হাতে থাকাই যুক্তিযুক্ত।
প্রসঙ্গত: নির্বাচন কমিশন ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করে। ভোটার তালিকার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কার্যক্রমও পরিচালিত হয় ইসির মাধ্যমে। ২০১০ সালে ইসির অধীনেই এনআইডি নিবন্ধন অনুবিভাগ একটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়।
ইসি’র সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিশনকে আরেকটি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ১৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঠানো পত্রের আলোকে সরকার জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম আইনানুগভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমতাবস্থায়, নির্দেশনাসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এদিকে ইসি থেকে স্বরাষ্ট্রে এনআইডি সেবা হস্তান্তর নিয়ে দেশের একশ্রেণির মানুষের আশঙ্কা, যেহেতু ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে এনআইডি ব্যবহার করা হয়, ফলে ভবিষ্যতে এটিকে কেন্দ্র করে ভোটের ফলাফল প্রভাবিত হলেও হতে পারে।