আইপিএস আমদানি বন্ধ : বেড়েছে দাম, ভরসা দেশীয় প্রতিষ্ঠানে
নিজস্ব প্রতিবেদক : লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন। বাসাবাড়ি তো বটেই, দোকানপাট ও শিল্পকারখানাও বর্তমানে বিদ্যুতের ঘাটতিতে ভুগছে। এর সঙ্গে ভ্যাপসা গরমে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। বিকল্প হিসেবে সচ্ছলদের মধ্যে অনেকেই এখন বাসাবাড়ি, অফিসে ব্যবহারের জন্য কিনছেন আইপিএস। হঠাৎ আইপিএসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দেখা দিয়েছে সরবরাহ ঘাটতি।
এদিকে ডলার সংকটে এলসি বন্ধ ও ডলারের বাড়তি দাম থাকায় আইপিএসের যন্ত্রাংশ এখন আমদানি হচ্ছে না। এতে করে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বাজারে কিনতে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে না আইপিএস। যদিও পাওয়া যাচ্ছে, গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। তবে আমদানি করা আইপিএস বাজারে কম পাওয়া গেলেও দেশি কোম্পানিগুলোর আইপিএস বাজারে পর্যাপ্ত পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে রহিম আফরোজের আইপিএস পাওয়া যাচ্ছে। একইসঙ্গে আমদানিকৃত আইপিএসের তুলনায় দামও কম। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
আইপিএস প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারকেরা বলছেন, গত কয়েক বছরে বিদ্যুতের ঘাটতি না হওয়ার ফলে আইপিএসের ব্যবসা একেবারে পড়তির দিকে ছিল। গত এক মাস আগে চাহিদা তেমন না থাকলেও লোডশেডিংয়ে গত ২০ দিন ধরে বিক্রি বেড়েছে। এতে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে ডলার সংকটে আমদানি চাপে থাকায় ঘাটতি প্রকট হয়েছে। এ খাতের দেশীয় কোম্পানিগুলো চেষ্টা করছে দ্রæত আইপিএস উৎপাদন করে বাজারে ছাড়তে। তবে একটু সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এসব কোম্পানি। কারণ, লোডশেডিং কমে গেলে এই পণ্যের চাহিদা আবার রাতারাতি কমে যেতে পারে বলেও মনে করছে তারা।
রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকায় আইপিএস বিক্রি অনেকটাই কমে গিয়েছিল। যারা একসময় আইপিএস ব্যবহার করতেন, তারাও এক পর্যায়ে পুরনো আইপিএস বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন লোডশেডিং থাকায় আইপিএস কিনতে ইলেকট্রিক দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা।
বিক্রেতারা বলেন, দেশে আইপিএস উৎপাদন করে মাত্র কয়েকটি কোম্পানি। তারাও আইপিএস এর যন্ত্রাংশ বাইরে থেকে আমদানি করে এনে দেশে তৈরি করেন। কিন্তু ডলার সংকটে এলসি বন্ধ ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি থাকায় এসব যন্ত্রাংশ এখন আমদানি হচ্ছে না। ফলে আইপিএস উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।
জানা গেছে, বর্তমানে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আইপিএস। এর মধ্যে অন্যতম লুমিনাস ও মাইক্রোটেক। এরপরই রয়েছে হ্যামকো, লিভগার্ড, এমাজি, ইউটিএল ডামা প্লাস, এক্সাইডের মতো কিছু প্রতিষ্ঠানের পণ্য। বাজারে দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের আইপিএসও বেশ ভালো বিক্রি হতে দেখা গেছে। তারমধ্যে রয়েছে রহিম আফরোজ, সাইফ পাওয়ারটেক, মাইক্রো পিএসের আইপিএস। তবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের আইপিএসের দাম বিদেশি ব্র্যান্ডের তুলনায় অনেক কম থাকায় এবং আমদানি কম হওয়ায় বাজারে দেশি ব্র্যান্ডের আইপিএসই বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান বিক্রেতারা।
রহিম আফরোজের মার্কেটিং অফিসার (আইপিএস) মাঝারুল ইসলাম বলেন, লোডশেডিংয়ের জন্য আইপিএসের এখন প্রচুর চাহিদা বেড়েছে। লোডশেডিং চলমান থাকলে কিছু দিন পর আইপিএস বিক্রি আরও বাড়তে পারে। আমাদের ছোট-বড় আইপিএস বাজারে পর্যাপ্ত রয়েছে। বিক্রি আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু আমরা একমাত্র প্রতিষ্ঠান, পণ্যের চাহিদা বাড়লেও দাম বাড়াইনি। আমাদের প্রতিষ্ঠান গত মার্চ মাসে সর্বশেষ আইপিএস এর দাম বাড়ায়। তা কোম্পানির পলিসি অনুযায়ী। এর পড় গত মে মাসের শেষে দিকে আইপিএসের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও আমরা আগের দামেই পণ্য বিক্রি করছি। তিনি বলেন, ৬০০ভিএ, ৭০০ভিএ ও ১০০০ভিএ এই আইপিএসগুলো চাহিদা অনেক বেশি। ফলে হঠাৎ যদি কেউ ৩০/৪০ ইউনিট আইপিএস একসঙ্গে নিতে চাইলে আমাদের কাছে আগে থেকেই অর্ডার দিতে হবে। কেননা শোরুমে তো এত ইউনিট আইপিএস থাকবে না। এ জন্য একটু সময় দিলে আমরা পণ্য দিতে পারব। তবে বাজারে এখন আমাদের আইপিএসই বিশ্ব মানের। পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে।
স্টেডিয়াম মার্কেটের মাইক্রো পিএস ইলেকট্রনিকের ডিলার বিএস আক্তার ফারুক ফখরুল বলেন, অতিরিক্ত লোডশেডিং ও অসহনীয় গরমের জন্য হঠাৎ গত ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে আইপিএসের চাহিদা বেড়ে গেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় আইপিএস বিক্রি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। এতে করে আইপিএস এর সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দামও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। তিনি বলেন, অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের জন্য আইপিএস ও ব্যাটারি উৎপাদন করতে পারছে না। একইসঙ্গে ডলার সংকট, উচ্চমূল্য, এলসি বন্ধ থাকায় গত ৬ মাসে তেমন কোন আইপিএস আমদানি হয়নি। ফলে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে কোথাও আমদানিকৃত আইপিএস পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু দেশি কোম্পানির কিছু আইপিএস বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মাইক্রো পিএসের একটি ৬০০ভিএ আইপিএস সেটে তিনটি লাইট ও ফ্যান চলে। যেটির দাম আগে ৩০ হাজার থেকে ৩২ হাজার টাকা ছিল। এখন তা ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমরা মেশিনে এক বছরের গ্যারান্টি ও ব্যাটারিতে দেড় বছরের ওয়ারেন্টি দিচ্ছি। আইপিএস ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে বাসাবাড়ির জন্য ৬০০ ভিএ থেকে ১২০০ ভিএ এই ধরনের আইপিএসের চাহিদা বেশি।
ইলেকট্রিক পণ্যের সবচেয়ে বড় মার্কেট নবাবপুর রোড সেখানে মোহন ইলেকট্রিক মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ী মুজিবুর রহমান ক বলেন, আমি কয়েকটি কোম্পানির পরিবেশক হিসেবে কাজ করছি অনেক দিন হলো। কিন্তু এমন পরিস্থিতি কখনো হতে দেখিনি। দেশে আবার কখনো আইপিএসের ব্যবসা চাঙা হতে পারে, এটা আমাদের ধারণাতেই ছিল না। বিদ্যুতের বড় সংকট ছাড়া আইপিএস এখন কেউ কেনেন না বললেই চলে। তিনি বলেন, হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমরা এখন চাহিদামতো আইপিএস দিতে পারছি না। ১০টি আইপিএসের জন্য বললে দিচ্ছে একটি বা দুটি। ফলে ক্রেতাদের দেওয়া কথা আমরা রাখতে পারছি না। আইপিএসের সরবরাহ এবার বেশ কম। ফলে অনেকে আইপিএস কিনতে এসে চার্জার ফ্যান কিনছেন। আইপিএসের জন্য বলে যাচ্ছেন। আমরা অর্ডার পেলে কোম্পানি বা আমদানিকারকের কাছ থেকে সংগ্রহ করে ক্রেতাদের সরবরাহ করছি।
রাজধানীর ইসলামপুরের পাটুয়াটুলীর মুন মার্কেটের আর কে ইলেকট্রনিকসের মালিক মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, আমাদের নিজস্ব কারখানায় আইপিএস তৈরি করি। আর ব্যাটারি অন্য জায়গা থেকে এনে দিই। লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর থেকে আইপিএসের চাহিদা বেড়ে গেছে। ঢাকার বাইরে থেকে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা আইপিএস নিতে দোকানে আসছেন। স্বাভাবিক সময়ে দিনে এক-দুটি আইপিএস বিক্রি হতো। এখন চাহিদা বাড়ায় দিনে চার-পাঁচটি আইপিএস বিক্রি হচ্ছে।