উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে : আইপিডি গবেষণা প্রতিবেদন
মো. আখতারুজ্জামান : দেশে প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও একই সঙ্গে বাড়ছে আয় বৈষম্য। ফলে দারিদ্র্য বেড়ে গেছে রংপুর অঞ্চলে। আর এতে উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। রংপুর বিভাগের দারিদ্র্যের হার এখন ঢাকা ও সিলেট বিভাগের চেয়ে তিন গুণ বেশি।
গত শনিবার বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দের আঞ্চলিক বিন্যাস শীর্ষক আইপিডি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ ও আলোচনা সভায় এ তথ্য উঠে আসেছে। অনুষ্ঠানে বলা হয়, বিবিএস (২০১৭) অনুসারে, রংপুর বিভাগের জন্য দারিদ্র্যের মাত্রা ৪৭ শতাংশ, যেখানে গড় জাতীয় দারিদ্র্যের মাত্রা ২৪ শতাংশ এবং দেশের ১০টি শীর্ষ দারিদ্র্যপীড়িত জেলার মধ্যে ৫টি জেলা রংপুর বিভাগ থেকে, যেখানে দারিদ্র্য বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুড়িগ্রাম জেলার দারিদ্র্য হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) উপদেষ্টা আক্তার মাহমুদ বলেন, এসব অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। সরকারকে বাজেটের ক্ষেত্রে সেক্টরভিত্তিক বরাদ্দের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্যগুলো নিরসনে কাজ করতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
সরকারের বাজেটে সেক্টরভিত্তিক বরাদ্দ দেয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার আহŸান জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার ৭ম বার্ষিক পরিকল্পনায় স্বীকার করে নিয়েছে যে আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা আছে। ২০টি জেলাকে পিছিয়ে পড়া জেলা হিসেবে চিহ্নিতও করা হয়েছে। ৭ম বার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি করার পরপরই চিহ্নিত এলাকাগুলোকে নিয়ে বিশেষভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে বরাদ্দ বাড়লেও আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনের জন্য তা এখনও যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, রংপুরের কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, গাইবান্ধা এলাকা মূলত চরাঞ্চল। অর্থাৎ যমুনা নদীর চর এলাকাগুলোতে নানা ধরনের প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাও আছে। আর আরেকটি দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা হচ্ছে হাওড়াঞ্চল।
আক্তার মাহমুদ বলেন, ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উন্নয়ন বিশ্লেষকরা যমুনা নদীকে একটি বিভক্তি রেখা ধরে বাংলাদেশের আঞ্চলিক উন্নয়নকে পূর্ব-পশ্চিম বিভক্তি নামে শনাক্ত করেছিল। এ প্রতিবেদনে মূল যে উপস্থাপনাটি করা হয়েছিল, সেখানে পূর্বাঞ্চল এগিয়ে ও পশ্চিমাঞ্চল পিছিয়ে ছিল। অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলের সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা অঞ্চলগুলো অনেক এগিয়ে অন্যদিকে পশ্চিমে থাকা দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশাল পিছিয়ে আছে।
২০০৮ সালের পরিস্থিতি বর্তমানে কিছুটা হলেও পরিবর্তন হয়েছে তা স্বীকার করে আইপিডি উপদেষ্টা বলেন, বিশেষ করে পদ্মা সেতু ও যমুনা সেতু হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। যার ফলাফল পরবর্তীতে লক্ষ্য করা যাবে। আমরা আশা করছি সরকারের পরিকল্পনায়ও সেটি রয়েছে।
আক্তার মাহমুদ বলেন, দরিদ্র এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করার ও বিশ্লেষণ করার জন্য সরকারের তথ্য উপাত্ত হালনাগাদ করার প্রয়োজন। কেননা, সবশেষ ম্যাপিংগুলো ২০২১ সালের। যা বিস্তারিত আমরা এখনও পাচ্ছি না। কাজেই তথ্য নিয়ে আলোচনা করতে হলে হালনাগাদ তথ্য উপাত্ত প্রয়োজন। বিবিএস’র প্রতিনিয়ত এই সব তথ্য প্রকাশ করা উচিত।
দরিদ্র এলাকার ম্যাপিংয়ের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২২ সালের একটি সেন্সাস করা হয়েছে যেখানে এখনও বিস্তারিতভাবে আয়-ব্যয় ও দারিদ্রতার হিসাবগুলো আসেনি। কিন্তু সেখানে যে তথ্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে সেটি হচ্ছে ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যতার পাশাপাশি চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে।
তবে দারিদ্র্যতা কমলেও আঞ্চলিক বৈষম্য পরিষ্কার উল্লেখ করে আক্তার মাহমুদ বলেন, রংপুরের ৪১ উপজেলায় অতি মাত্রায় দারিদ্র্যতা রয়েছে। একইভাবে ময়মনসিংহ এলাকায় এখনো একটি বড় সংখ্যক উপজেলা রয়েছে যেগুলো দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা। যেখানে দারিদ্র্যতার হারও অনেক বেশি। এছাড়া সাতক্ষীরা ও বরিশালে দারিদ্র্যতার হার অনেক বেশি। তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি সময়ের সঙ্গে এ অঞ্চলগুলোয় বরাদ্দ বাড়ছে। কিন্তু দিনাজপুরে দারিদ্র্যতার হার বেশি হলেও সেখানে কিন্তু বরাদ্দ সেভাবে বাড়েনি। যেসব উপজেলায় বরাদ্দ অনেক কম বেড়েছে তার মধ্যে রয়েছে রাঙামাটি, বান্দরবান, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর ও নওগাঁ।
আঞ্চলিক বৈষম্য কমাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে উল্লেখ করে বক্তারা জানান, বিশেষ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, মানব সম্পদ উন্নয়ন, এসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তাহলে একটি শিক্ষিত, কর্মঠ ও দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে উঠবে। যা বৈষম্য কমাতে সহায়তা করবে। তারা বলেন, এমন প্রকল্প নেয়া উচিত যাতে পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাÐ বাড়বে। যা বৈষম্য কমাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে।
আক্তার মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ খুব বড় দেশ না। বাংলাদেশের ছোট ছোট অঞ্চলে বরাদ্দ বাড়বে এবং অন্যান্য অঞ্চল বরাদ্দ কম পাবে, এটি এমন হওয়ার কোনো কারণ নেই। সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনা করা দরকার। কোথায় কোথায় সমস্যা আছে সেগুলো ম্যাপিং দরকার। ম্যাপিং করে প্রয়োজনভিত্তিক বরাদ্দ দেয়া হলে দেশের মানুষ উপকৃত হবে।
দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা টেকসই করার বিষয়ে কাজ করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ১০০ ইপিজেডের ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এগিয়ে এবং প্রাইভেট ইপিজেডের ২৭টির মধ্যে ১৯টিই ঢাকায়। অথচ পিছিয়ে পড়া জায়গাতেই ইপিজেডগুলো আগে করা দরকার ছিল।
আলোচনায় আইপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, আয় ও ব্যয় খানা জরিপে (হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে, ২০১৫) অনুযায়ী, ১৯৯৫-৯৬ সালে দারিদ্র্যতার হার যেখানে ৫১ শতাংশ ছিল, তা ২০১৭ সালে কমে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সত্তে¡ও স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পা ও কর্মসূচি সেক্টর খাত ভিত্তিক নেয়া হয়েছে। আঞ্চলিক বিবেচনায় নেয়া হয়নি। আঞ্চলিক পর্যায়ে, দারিদ্র্যতা নিরসনের গতি সব অঞ্চলে সমান নয়। কিছু অঞ্চল বেশ পিছিয়ে রয়েছে, যেখানে অন্যগুলো বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।
এইচআইইএস-এর ২০১৫ একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরিশাল, দারিদ্র্যতার হার এখনো পশ্চিম অঞ্চলের তুলনায় পূর্ব অঞ্চলে কম। উত্তর পশ্চিম বিভাগে খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও রাজশাহীর দারিদ্র্যের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। আর দক্ষিণ পূর্ব বিভাগের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে দারিদ্র্যের ঘটনাগুলো তুলনামূলকভাবে কম। তিনি আরও জানান, দেশে সবচেয়ে গরিব মানুষ এখন কুড়িগ্রামে। এই জেলার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই গরিব। এরপরই অবস্থান দিনাজপুরের। এই জেলায় দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে ৬৪ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে গরিব মানুষ সবচেয়ে কম নারায়ণগঞ্জে, মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ।