ব্রিকসে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের যোগদান ভাববার কিছু বিষয় রয়েছে
ওয়াসি মাহিন
স্পুতনিকের বরাতে তথ্য আসছে রাশিয়া ব্রিকসে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাবে। এদিকে চীন স্পষ্ট করেই বলেছে বাংলাদেশকে তারাও অভিনন্দন জানায়। ভারতের বিষয়টা আমার চোখে পড়েনি।
যখন বড় ধরনের কোন পরিবর্তন হয় তখন নতুন ব্যাবস্থায় স্থিতি আসার আগ পর্যন্ত চড়াই উৎরাই একটা সময় যায়। একটা সরকার পরিবর্তন হয়ে অন্য সরকার আসলে স্টাবিলিটি ফিরতে কিছু সময় লাগে। একটা সম্রাজ্যের পতন হয়ে নতুন সম্রাজ্য আসলে পুরো সম্রাজ্যজুড়ে অস্থিতিশীল একটা সময় আসে। যদি নতুন সম্রাট সম্রাজ্যকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয় তবে নতুন সম্রাজ্যের স্থায়ীত্ব সঙ্কায় পড়ে। আর যদি সফল হয় তাহলেও সামগ্রিক স্ট্রাবিলিটি আসার আগ পর্যন্ত অস্থিতিশীল পরিবেশ থাকে। এই অস্থিতিশীল পরিবেশটা মোকাবেলা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সবথেকে বড় সফলতা বা চ্যালেঞ্জ। এই অন্তরবর্তীকালীন সময়টা ঝুকিপূর্ণ। অনেকটা সংগ্রামের পর নতুন দেশের জন্ম ও সেটাকে স্থিতিশীল করার মত।
বর্তমানে সম্রাজ্যের প্রকৃতি পরিবর্তন হয়েছে। এখন গ্লোবালাইজেশন এর প্রভাবে একটি দেশ অন্য দেশের উপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল। যেহেতু বিশ্ব অর্থব্যবস্থার নিয়ন্ত্রন আমেরিকার হাতে তাই আমেরিকার উপর বিশ্বের সবদেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নির্ভরশীল। আমেরিকা অন্য দেশের এই নির্ভরশীলতাকে কাজে লাগানোর জন্যই মূলত নতুন ব্যবস্থার সূত্রপাত। যেমন ব্রিকস।
ব্রিকসে বাংলাদেশ যুক্ত হবে কি হবেনা এটা নিয়ে প্রশ্ন করাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূলত কোন দেশ রাগ করবে ভেবে এরকম সংগঠন থেকে দূরে থাকার পক্ষে আমি নই। জঈঊচ তে যুক্ত হবার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলেছি। ব্রিকস এর ক্ষেত্রেও একি কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশ নোটেবল কোন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারেনি যেটা বাংলাদেশের বৈশ্বিক পরিচিতি ও ব্রান্ডিং এর জন্য নেতিবাচক। এখানে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ বা এর অঙ্গসংগঠনের মত জোটের সদস্য হওয়াকে বুঝাচ্ছিনা।
বাংলাদেশ যে জোটগুলির সাথে আছে সেগুলার ভেতর উল্লেখযোগ্য হল সার্ক, বিমসটেক ও ডি-৮। এই তিনটিই আদতে খুব বেশি ফাংশনাল নয় বা সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সফল হয়নি।
ব্রিকস এ যুক্ত হওয়া ভাল সিদ্ধান্ত। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টা নিয়ে একটু চিন্তার বিষয় আছে।
ব্রিকসের প্রতিষ্ঠার পেছনে আমার কেন জানি মনে হয় ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা বা ভারতের মত দেশের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষধে উপস্থিতির অপূর্ন স্বপ্নের প্রভাব রয়েছে। সাউথ আমেরিকা মহাদেশের কোন প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষধে নেই। দ্বিতীয় বৃহৎ মহাদেশ আফ্রিকার ক্ষেত্রেও একি কথা প্রযোজ্য। ভারত দীর্ঘকাল ধরে চেষ্টা করেও লাভ হয়নি।
আরেকটি দিক ভাবা যেতে পারে। জাতিসংঘ বা জি-৭ এগুলা মূলত উন্নত দেশের সংগঠন অথবা উন্নতা দেশের নীতির প্রতিফলনে বিকশিত। উন্নয়নশীল দেশের ভয়েস পৌছানোর ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। এসব দেশের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতার ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বৈশ্বিক সংগঠনগুলি অনেকটাই পরিনত হয়েছে এলিট মনস্বত্তে¡র সংগঠন।
কিন্তু কোন একটা সংগঠন সফল হতে গেলে সদস্যদেশগুলির সদিচ্ছা ও সমাধানকেন্দ্রীক শান্তির নীতি জরুরি। চীন ভারতের পারস্পারিক বিদ্বেষ এক্ষেত্রে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
ব্রিকস এর শুরুর দিকে এটাকে রাজনৈতিক সংগঠনের থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলির জোট হিসাবে বেশি ধরে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আমেরিকা চীন বাণিজ্য যুদ্ধ, পারস্পরিক নিষেধাজ্ঞা, চিপ ওয়ার, একে অন্যের কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞা, এবং তৎপরবর্তীকালে রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ ও ন্যাটোর বিস্তার নিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতি ব্রিকসকে বৃহৎ উন্নয়নশীল দেশগুলির জোটের থেকে এর রাজনৈতিক মেরুকরণের ইঙ্গিতকে বেশি স্পষ্ট করেছে। মেম্বার দেশগুলির ভেতর রাশিয়া ও চীন এক্ষেত্রে স্পষ্টত রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের প্রচারে লিপ্ত।
ডলার এতদিন যে কারনে বিশ্বের কাছে নিরাপদ কারেন্সি ছিল তার অন্যতম কারন হল ডলারকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার না করা। ব্রিকসের সাউথ আফ্রিকা মিটিংয়ের আগে থেকেই যেভাবে ব্রিকস কারেন্সি দিতে ডলারকে প্রতিস্থাপন করা হবে বলে প্রচার করা হচ্ছে এতে হয়ত উপকারের থেকে অপকার বেশি।
আমেরিকার ডলার আমেরিকাকে বিশ্বের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য ফলানোর সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু ডলার প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে নিষেধাজ্ঞার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের পর থেকেই। রাজনৈতিক এসব সিদ্ধান্তের কারনে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এমনকি ইজরাইলের কাছেও ফরেন কারেন্সি পোর্টফলিওতে ডলারের অংশ কমে অন্যন্য মুদ্রার অংশ বেড়েছে। এর লুক্কায়িত অর্থ হল, বিশ্ব সুস্থ বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য একটা নন-পলিটিকাল কারেন্সি চায়। সত্য হল, এটা এটা আসলেই দরকার।
ব্রিকস কারেন্সি যদি যাত্রা করে এবং গ্লোবাল গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে চায় তবে অবশ্যই এই কারেন্সিকে নন-পলিটিকাল কারেন্সি হিসাবে আস্থা অর্জন করতে হবে। আর সেটা করতে গেলে ব্রিকস এর পলিটিকাল মেরুকরন বাধা হয়ে দাড়াতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে ব্রিকস কারেন্সিকে ভবিষ্যতে কারেন্সি যুদ্ধে ডলারের বিপরীতে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে। আর এটা বৈশ্বিক কারেন্সিকে আরো সামরীকিকরনকে উস্কে দিতে পারে। আরো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির নিয়ামক হতে পারে এই কারেন্সি।
ব্রিকস কারেন্সির যাত্রাতে যদি এটা ডলারের কাউন্টার ভেবে প্রচার করা হয় তবে সাময়িক সফলতা পেলেও বৈশ্বিক আস্থা অর্জনে এই কারেন্সিকে ভুগতে হবে। এরকম ক্ষেত্রে নিউট্রাল কারেন্সি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা আরো চ্যালেঞ্জের হবে। যদি ব্রিকস এর পলিটিকাল এসপেক্ট বিশ্বে কারেন্সি ওয়ারের সূচনা করে তবে বিশ্ব বাণিজ্য আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সামনে হয়ত আরো অস্থিতিশীল হবে বৈশ্বিক কারেন্সি মার্কেট। এটাকে আমি উপরে বোঝাতে চেয়েছি অন্তরবর্তীকালীন অস্থিতিশীলতা হিসাবে।
হয়ত ধীরে ধীরে এটা স্টাবল হবে কিন্তু অনেক দেশ এই কারেন্সি যুদ্ধের বলি হতে পারে। আর এই দিকটা বাংলাদেশের জন্য ভেবে দেখা দরকার।
ব্রিকস কে হয়ত ব্রিকস প্লাস করা হবে। এখানে যুক্ত হতে ইতোমধ্যে আবেদন করেছে বাংলাদেশ, আলজেরিয়া, মিশর, আর্জেন্টিনার মত দেশ। সৌদি আরব, ইউএই, ইন্দোনেশিয়া তুরস্কের মত দেশ এই জোটে যুক্ত হলে এটা ভবিষ্যতের বিশ্বনীতির প্রণয়ন ও প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে।
বাংলাদেশকে এটা নিয়ে খুব বেশি প্রচারে যাওয়া উচিত হয়নি। এই ইস্যুগুলি সেন্সিটিভ। আমাদের নিরপেক্ষতার নীতি নিয়েই জোটে যুক্ত হতে হবে। জোটের পলিটিক্যাল সিদ্ধান্তে নিজেদের সংবরণ করতে হবে। স্টাবিলিটির জন্য ভ‚মিকা রেখে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা শান্তিতে বিশ্বাসী।
অনেকেই ভাবছেন যে এখানে যোগ দিলে হয়ত আমেরিকার বাজার হারারে হবে, ইউরোপের বাজার হারাতে হবে। আমার এমনটা মনে হয়না। তবে যদি আমরা আগ বাড়িয়ে বেশি শো অফ করতে চাই তবে সেটার ফলাফল আপাতত ভাল হবেনা। বিশ্বে আমাদের শক্ত উপস্থিতি দরকার। এর জন্য প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরে স্টাবিলিটি আনা। নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করা।
আর ভবিষ্যত কারেন্সি ওয়ারের শক আমরা কিভাবে মোকাবেলা করব সেটা নিয়ে এখনি পরিকল্পনা করা। প্লান এ প্লান বি রেডি করা। কিছু ক্ষেত্রে প্রোয়েকটিভ হতে নেই। কিন্তু ক্ষেত্রে রিয়েক্টিভ হতে নেই। এই ক্ষেত্র গুলি অনুধাবন করা।