রাজনৈতিক প্রভাবে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে অতিরিক্ত জনবল : টিআইবি
মো. আখতারুজ্জামান : নানা সমস্যায় জর্জরিত রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন করা হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২১ সালে তিন বছরের বকেয়া নবায়ন একত্রে করা হয়েছিল। হাসপাতালের পরিচালকের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান। পরিচালক পরিবর্তন হলে হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এমন অজুহাতে ঘন ঘন পরিচালক পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া রাজনৈতিকভাবে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মোট জনবল ৬৫২ জন। এর মধ্যে চিকিৎসক ১০২, নার্স ২০৬, অফিস স্টাফ ২৮৯ এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মী ৫৫ জন।
রোববার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মুহাম্মদ বদিউজ্জামান ও মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন টিআইবির কনসালটেন্ট তাসলিমা আক্তার ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (গবেষণা ও পলিসি গবেষণা) মো. মাহ্ফুজুল হক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রয় আইন, তথ্য অধিকার আইন ও মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল সংক্রান্ত আইন অমান্য করলেও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে জবাবদিহি নিশ্চিত হয়নি। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অসম চুক্তিসহ বিবিধ দুর্নীতির কারণে চিকিৎসা সেবার মান নিম্নগামী হয়েছে। সুনাম নষ্ট হয়েছে, রোগীর পরিমাণ ও হাসপাতালের আয় হ্রাস পেয়েছে। ফলে ব্যর্থ হয়ে ক্রমেই একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, হাসপাতালের জন্য পৃথক জনবল কাঠামো না থাকায় অপরিকল্পিত নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিসহ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে কোনও জবাবদিহি নেই। একটি মানবিক সহায়তা সংস্থা এবং রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের অংশ হলেও হাসপাতালটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার কর্তৃক অনুদান এবং আয় ও ব্যয়ের হিসাব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে নথিভুক্ত করেনি, যা অংশীজনদের আস্থার সংকট তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়নি। ফলে হাসপাতালের কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
হাসপাতালটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রূপান্তরিত হলেও প্রয়োজনীয় সব রোগের চিকিৎসা যেমন- লিভার, গলবøাডার, পিত্তনালী ও অগ্ন্যাশয়ের অবস্থা নির্ণয়, পাথর অপসারণে ইআরসিপি যন্ত্র, এমআরআই যন্ত্র, চক্ষু ও ডেন্টাল ইউনিটে যন্ত্রপাতি, স্কিনের চিকিৎসায় লেজার যন্ত্র, মেমোগ্রাফি, বায়োপসি, টিবি পরীক্ষার যন্ত্র, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট রোগীকে শক দেওয়ার জন্য ডিফিব্রিলেটর যন্ত্র নেই। বাইপাস সার্জারি, এনজিওগ্রামসহ জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাও নেই। এন্ডোসকপি ও কোলোনোস্কোপি যন্ত্রটি পুরনো হওয়ায় সেবা কার্যক্রম ব্যহত হয়। ওটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে।
টিআইবি জানায়, কেবিনের রোগীর শয্যার চাদর প্রতিদিন বদলানো হয় না। রোগীর পক্ষ থেকে বলা হলেও পরিবর্তন করা হয় না। এমনকি ভর্তির পর ৪ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মাত্র একদিন বিছানার চাদর পরিবর্তন করার অভিযোগ রয়েছে।
চিকিৎসা সেবা কাজে ডাক্তার ও নার্সদের গাফিলতি সম্পর্কে অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। যেমন- রোগীর ফাইল চেক না করে সুন্নতে খতনার রোগীর গলার টনসিল অপারেশন, কর্তব্যরত নার্স কর্তৃক নির্ধারিত ওষুধ না দিয়ে অন্য ওষুধ দেওয়ায় রোগীর অবস্থার অবনতি ও আইসিইউতে ভর্তি করানো, ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যু এবং হাসপাতালে বিশৃঙ্খলা ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।
৫২৮ শয্যার হাসপাতালটিতে ৬৫২ জনের বেশি জনবল রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ জনের বেশি প্রশাসনিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগের ফলে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আবার হাসপাতালের প্রাত্যহিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনায় চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে, নিজস্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মীর স্বল্পতা রয়েছে। কর্মরত মোট ৫৫ জনের মধ্যে নিজস্ব মাত্র ১৯ জন। অধ্যাপক ও জুনিয়র চিকিৎসকের স্বল্পতা, বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সেবাগ্রহীতাদের অসন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্বক্ষণিক কনসালটেন্ট রয়েছে মাত্র তিন জন।
২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের তথ্যানুযায়ী, বেতন বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকার ঘাটতি প্রায় ৮ কোটি টাকা, হাসপাতালের কাছে ওষুধ কোম্পানির বকেয়া প্রায় ৪ কোটি টাকা, অবসরপ্রাপ্তদের গ্র্যাচুয়িটির প্রায় ৩১ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে প্রায় ১৮ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে।
সাধারণ জনগণ হাসপাতালের সুনির্দিষ্ট সেবা সম্পর্কে অবগত হতে পারে না। হাসপাতালের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত কেবিন ও সিট ভাড়া। কিন্তু রোগী কমে ৫২৮ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রোগী থাকায় হাসপাতালের আয় হ্রাস পেয়েছে।
হাসপাতালটির লাইসেন্স ২০২১ সালে তিন বছরের বকেয়া নবায়ন একত্রে করা হয়। লাইসেন্স পুনঃনবায়ন ছাড়াই বর্তমানে হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ২০২১-২০২২ সালের নবায়ন সম্পন্ন না করেই কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যবস্থাপনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচন করা হয়েছে। চেয়ারম্যানের কথামতো কাজ না করায় হাসপাতাল পরিচালকের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে। পরিচালক পরিবর্তন হলে হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে— এমন অজুহাতে ঘন ঘন পরিচালক পরিবর্তন করার ঘটনা ঘটেছে।
হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগেও দলীয় প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও পরিচিত বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। চিকিৎসক নিয়োগে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। চাকরি প্রার্থীদের কাছে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ চাওয়া হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ও সিনিয়র চিকিৎসকের সুপারিশে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে চিকিৎসক ও কর্মচারী নিয়োগেরও অভিযোগ রয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সুশাসন নিশ্চিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার অকেজো কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি যা আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।