ডেঙ্গু জ্বরে প্লাটিলেট নিয়ে অহেতুক উদ্বেগ, আতঙ্কিত হবেন না :ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল, রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
ভূঁইয়া আশিক রহমান
[২] জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল বলেছেন, ডেঙ্গু এখন নতুন কোনো রোগ নয় বাংলাদেশে। এই রোগের প্রকোপ আবারও বাড়ছে। ডেঙ্গুর লক্ষণ, ধরন, প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে অনেক আলাপ হলেও জনসচেতনতা বাড়েনি তেমন। ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক কমেনি। এই রোগ নিয়ন্ত্রণেও আসেনি। ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগÑ এটি আমরা আগেই জেনে গেছি। ভাইরাসটি ছড়ায় মূলত এডিস ইজিপ্টি বলে একধরনের মশার মাধ্যমে। এই মশারা আগে পুরনো বদ্ধ পানিতে বাস করলেও এখন এদের ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ময়লা পানিতেও এদের জন্ম হচ্ছে।
[৩] আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর জ্বর সাধারণত হয় আকস্মিক ও ধারাবাহিক ধরনের। অনেকে মনে করেন, ডেঙ্গুতে বোধহয় উচ্চমাত্রার জ্বর হয়। কথাটি আংশিক সত্য। ডেঙ্গুতে উচ্চমাত্রার, নি¤œমাত্রার, গায়ে গায়ে জ্বর, এমনকি জ্বর নাও থাকতে পারে। জ্বর সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয়। মাঝে দুই দিন জ্বরবিহীন থাকতে পারে এবং আবার ফিরে আসতে পারে। একে বলে ‘স্যাডল ব্যাক ফিভার’। চোখ ও চোখের কোটরে ব্যথা, হাড়ে ও মাংসপেশিতে প্রচÐ ব্যথা, শরীরে লাল দাগ বা র্যাশ। রক্তে প্লেটিলেট বা অনুচক্রিকা কমে গিয়ে এটা হয়। শরীর অস্বাভাবিক দুর্বলতা, বমি, পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানাও কোনো কোনো সময় হতে পারে, বিশেষ কোনো লক্ষণ ছাড়াও হতে পারে।
[৪] লক্ষণভেদে ডেঙ্গুকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করি। [১] ডেঙ্গু ফিভার, [২] হেমোরেজিক ডেঙ্গু। হেমোরেজিক ডেঙ্গুর দুই রকম পরিণতি হতে পারে। সাধারণ হেমোরেজিক ডেঙ্গু ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। সাধারণ ডেঙ্গু ফিভার নিয়ে ভয়ের তেমন কারণ নেই। এটা সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বরের মতো নিজে নিজে ঠিক হয়ে যায়। সাধারণ ডেঙ্গু ফিভারেও প্লেটিলেট কমে যেতে পারে এবং র্যাশ বা ত্বকে ছোপ ছোপ লাল দাগ হতে পারে। প্লেটিলেট কমে গিয়ে র্যাশ বা ত্বকের লাল ছোপ ছোপ দাগের পাশাপাশি বিশেষ ধরনের রক্তক্ষরণ দেখা দিলে তাকে হেমোরেজিক ডেঙ্গু বলে। এই বিশেষ ধরনের রক্তক্ষরণ বলতে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, রক্ত বমি হওয়া ইত্যাদি বোঝায়। সাধারণ হেমোরেজিক ডেঙ্গু নিয়েও আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কারণ নেই।
[৫] ডেঙ্গু জ্বরে ভাইরাসের অ্যান্টিজেনের কারণে শরীরের ইমিউন সিস্টেমের বিশেষ প্রতিক্রিয়ায় রক্তনালির ছিদ্র বড় হয়ে যায়। তখন রক্তনালি থেকে রক্তরস বা প্লাজমা বেরিয়ে আসে। একে বলে প্লাজমা লিকেজ। এই অবস্থায় প্রেশার কমে যায়, পালস দুর্বল হয়ে যায়, ফুসফুস ও পেটে পানি জমে ইত্যাদি। একইসঙ্গে রক্তের হেমাটোক্রিট বা কোষীয় অংশের অনুপাত বেড়ে যায়। এ অবস্থাটিই মূলত ডেঙ্গুর জটিল অবস্থা। তবে সবচেয়ে জটিল অবস্থা হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। প্লাজমা লিকেজের কারণে ডেঙ্গু রোগীর যখন প্রেশার কমে যায়, নাড়ির গতি বেড়ে যায় ও নাড়ি দুর্বল হয়ে যায়, রোগী অচেতন হয়ে যায় বা অস্থির হয়ে যায়, তখন একে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এই অবস্থায় রোগীকে আইসিইউতে নিতে হয়। ডেঙ্গুর জটিলতা হিসেবে মস্তিষ্কে ইনফেকশন (এনসেফালোপ্যাথি), জিবিএসসহ জটিল স্নায়ুরোগ ও লিভার ফেইলিউরও হতে পারে। তবে এগুলো খুবই বিরল।
[৬] সাধারণ মান্ষু ও চিকিৎসকদের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে বেশকিছু ভুল বোঝাবুঝি আছে, বিশেষ করে ডেঙ্গু রোগে প্লাটিলেট কাউন্ট ও বøাড ট্রান্সফিউশন নিয়ে রোগীরা আতঙ্ক ও বিভ্রান্তিতে ভোগেন বেশি। দেখা যায়, প্লাটিলেট কাউন্ট ৫০ হাজারের নিচে নামলেই রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং ঘন প্লাটিলেট কাউন্ট জানার চেষ্টা করে। কিন্তু এটা জেনে রাখা দরকার যে প্লাটিলেট কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া দিয়ে ডেঙ্গু রোগের তীব্রতা মাপা হয় না। প্লাটিলেট ঠিক থাকলে রোগী ভালো থাকবে তা-ও নয়।
[৭] প্লাটিলেট দিলেই যে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে এমনও নয়। ফলে এই অহেতুক প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন ডেঙ্গুকে বরং জটিল করে তোলে। মনে রাখবেন, প্লাটিলেট দেওয়ার ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে। রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা দিলে এবং প্লাটিলেট কাউন্ট ২০ হাজারের নিচে নামলে অথবা রক্তক্ষরণ নেই কিন্তু প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে, তবেই প্লাটিলেট দেওয়ার কথা ভাবা হয়। প্লাটিলেট কমে যাওয়া (থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া) কোনো মেডিক্যাল ইমারজেন্সি নয়। অর্থাৎ প্লাটিলেট কমে যাওয়া মাত্রই রোগী রক্তক্ষরণ হয়ে হঠাৎ মারা যাবে বিষয়টি এ রকমও নয়। প্লাটিলেট কমলে শরীরে একধরনের মাইনর ক্যাপিলারি বিøডিং (ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ বা এই জাতীয়) হয়।
[৮] রোগী মারা যায় মূলত ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। অর্থাৎ ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে রক্তনালিগুলো আক্রান্ত হয়। রক্তনালির গায়ে যে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে সেগুলো বড় হয়ে যায়। তা দিয়ে রক্তের জলীয় উপাদান বা রক্তরস বের হয়ে আসে। তখন রক্তচাপ কমতে থাকে, পিসিভি বা প্যাকড সেল ভলিউম বাড়তে থাকে। এটা ঠেকাতে তখন রোগীকে পর্যাপ্ত ফ্লুইড বা তরল দিতে হবে। এই তরল মুখে খাওয়ানো যেতে পারে বা শিরায় দেওয়া যেতে পারে। ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কতো তা ঘন ঘন না দেখে রোগীর রক্তচাপ ঠিক আছে কি না, রোগী পানিশূন্যতায় ভুগছে কি না, রক্তের পিসিভি বা হেমাটোক্রিট কেমন তা দেখা উচিত। যদি এমনটি হয় তাহলে পর্যাপ্ত তরল দিন বা ফ্লুইড কারেকশন করুন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
[৯] চিকিৎসকদের উচিত, রোগীর চিকিৎসা ও মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে হেমাটোক্রিট ভ্যালু ও রক্তচাপকে গুরুত্ব দিয়ে শিরায় নরমাল স্যালাইন দেওয়া। নরমাল স্যালাইনে কাজ না হলে কলয়েড সলিউশন দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর ন্যাশনাল গাইডলাইনটি সবার ফলো করা উচিত।
[১০] ডেঙ্গু রোগে প্লেইটলেট কাউন্ট এবং এর ট্রান্সফিউশন নিয়ে রোগীরা আতঙ্ক ও নানারকম বিভ্রান্তিতে ভুগতে থাকে। সমস্যা হচ্ছে শুধু রোগী না বড় বড় ডাক্তাররাও এই প্লেইটলেট কমে যাওয়া নিয়ে বিরাট আতঙ্কে ভুগতে থাকেন। রোগীদেরও আতঙ্কিত করেন। প্লেইটলেট কী, তার কাজ কী, কীভাবে কাজ করে সেটা নিয়ে ঠিক মত মাথা খাটালে এই আতঙ্কটা থাকার কথা ছিল না। কেউ কেউ প্রোফাইলেকটিক (আগাম সতর্কতা মূলক) প্লেইটলেট দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। এজন্য তারা কিছু নিজস্ব যুক্তিও তৈরি করেন। যেমন : [১] রোগী খারাপ হয়ে গেলো তারপর প্লেইটলেট দেবো? [২] যখন প্রয়োজন পড়বে তখন তো রেডি করতে করতে দেরি হয়ে যাবে। রোগী যদি খারাপ হয়ে যায় ততোক্ষণে! [৩] বাড়ায়ে রাখলাম, ক্ষতি তো নেই। এগুলো মূলত মনগড়া, আতঙ্কপ্রসূত এবং স্যরি টু সে, বিষয়টি অনেকখানি অজ্ঞতা প্রসূত।
[১১] প্রথম নম্বরের উত্তর হলো আপনি কখন প্লেইটলেট দেবেন তার একটা গাইডলাইন আছে। রক্ত ক্ষরণের চিহ্ন দেখা দিলে এবং প্লেইটলেট কাউন্ট বিশ হাজারের নিচে নামলে তবেই প্লেইটলেট দেবার কথা ভাবতে পারেন। ২. প্লেইটলেট কমে যাওয়া (থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া) কোন মেডিকেল ইমারজেন্সি না। মানে প্লেইটলেট কমে যাওয়া মাত্র রোগী রক্তক্ষরণ হয়ে ঠাস করে মরে যাবে এরকমও না। সময় পাবেন। প্লেইটলেট কমলে মূলত একধরণের মাইনর ক্যপিলারি বিøডিং হয়। ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ বা এইসব। ৩ নম্বর পয়েন্টটা ছিল বাড়ায়ে রাখলাম ক্ষতি তো নাই। উত্তর, অবশ্যই ক্ষতি আছে। আপনি অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলেন। একেতো ডেংগি শক সিন্ড্রোমের আশংকা, তার উপর এই ট্রান্সফিউশন দিয়ে আপনি রোগীর কম্পলিমেন্ট সিস্টেমকে আরো উত্তেজিত করে তুললেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন খুব প্রয়োজন ছাড়া এই জিনিস দেয়া মূলত বাড়তি কিছু ঝুঁকি নেয়া।
[১২] প্রশ্ন হতে পারে এক ইউনিট আগাম প্লেইটলেইট দিয়ে রোগীর কি কোন উপকার হয়? প্লেইটলেট উৎপাদন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা প্রতি নিয়ত তৈরি হচ্ছে এবং ভাংছে। আপনার এই আগাম পাচ দশ হাজার প্লেইটলেট যোগ করা আর না করা প্রায় সমান কথা? ইনফেকশন হতে পারে এই ভেবে আগাম এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দেয়াটা যেই মাপের অপচিকিৎসা এটাও সেই মাপের অপচিকিৎসা।
[১৩] কখন দেবেন? প্লেইটলেট তখনই দেবেন যখন রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা দেবে শরীরে। র্যাশ হবে, রক্তক্ষরণ হবে কেবল তখনই দিতে পারেন প্লেইটলেট। আর রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখলেই আতংকিত হবেন না? এইটুকু রক্তক্ষরণে কিছু হবেনা। রক্তক্ষরণের চিহ্ন নেই কিন্তু প্লেইটলেট দশ হাজার বা তার নিচে? তাহলেও প্লেইটলেট দিতে পারেন। ডেংগিতে প্লেইটলেট আসলে খুব রেয়ারলি দিতে হয়। আর সিদ্ধান্তটিও নেবে আপনার ডাক্তার? ডেঙ্গুতে বারবার প্লেটলেট মাত্রা দেখবারও কোনো প্রয়োজন নেই? এটা দেখে রোগের তীব্রতাও বুঝা যায়না। প্লেইটলেট পর্যাপ্ত থাকার পরও রোগী খারাপ হতে পারে। মরেও যেতে পারে?
[১৪] জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামলই যথেষ্ট। এসপিরিন, ব্যথার ওষুধ নিষেধ। এগুলো রক্তক্ষরণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেবে। অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না। সুতরাং অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না। রুচি অনুযায়ী খাবার খাবেন। তবে প্রচুর তাজা ফলের রস, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি ইত্যাদি খাবেন। বাজারের প্রিজারভেটিভ দেওয়া জুস খাবেন না। প্রতিদিন আড়াই থেকে চার লিটার তরল খেতে হবে এই সময়। বাচ্চাদের ঘন ঘন তরল খেতে দেবেন। প্রতিদিন প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১০০ মিলি তরল দিতে হবে। খেতে না পারলে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোনোভাবেই যেন পানিশূন্য না হয়ে পড়ে।