মুদ্রাস্ফীতি বা লোভ-স্ফীতি!
আনু মোহাম্মদ
জুন মাসÑ বাংলাদেশে জনগণের আতঙ্কের মাস। কারণ এই মাসে বাজেট ঘোষণার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়। এ বছর এমন দাম বাড়ানো শুরু হয় তারও আগে এবং জুনের প্রথম দিন থেকে অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করলে তা আরও খারাপ হয়।
অপচয় ও দুর্নীতির উৎস : বাংলাদেশে আর্থিক বছর জুনে শেষ হয় এবং পরের বছর জুলাই মাসে শুরু হয়। এটা সাধারণ জ্ঞানের বিষয় যে জুলাই-জুন বাংলাদেশের আর্থিক বছরের জন্য মোটেই সম্ভব নয়। কারণ অনিশ্চিত আবহাওয়া এবং শেষের মাসগুলোতে বর্ষাকাল। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো আরও কয়েকটি দেশ এখনও এই আর্থিক বছর অনুসরণ করছে। বেশির ভাগ দেশই ভিন্ন ভিন্ন টাইমলাইন অনুসরণ করে। ভারতের আর্থিক বছর ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ, যুক্তরাজ্যের ৬ এপ্রিল থেকে ৫ এপ্রিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১ অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর এবং চীনের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। আসলে ১৪ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল সেরা হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য আর্থিক বছর। কারণ এটি বাংলা বছরের বৈশাখ-চৈত্রের সঙ্গে মিলে যায়, যখন লোকেরা দীর্ঘ সময় ধরে বার্ষিক হিসাব করতে অভ্যস্ত হয়। অথবা এটি জানুয়ারি-ডিসেম্বর হতে পারে, জুলাই-জুন থেকে অনেক ভালো। যদিও আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটিকে আরও ভালো করার জন্য পরিবর্তন করার জন্য পয়েন্ট তৈরি করার চেষ্টা করছি, তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা, ব্যাখ্যাতীত কারণে, পুরানো অভ্যাসটি ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক নন, যা বিশাল অপচয় এবং দুর্নীতির কারণ।
ক্রমবর্ধমান দাম এবং সুবিধাভোগী : একের পর এক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান দাম জনমনে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সরকারের মূল্যস্ফীতির হার, অর্থাৎ প্রায় ১০ শতাংশের দাবি আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না। আমরা যদি খরচের ঝুড়িটি আলাদা করি এবং মৌলিক প্রয়োজনীয় খাদ্য আইটেমগুলোতে ফোকাস করি, তাহলে এটি ২০ শতাংশের বেশি চলে যায়। সা¤প্রতিক বাজার সমীক্ষায় দেখা গেছে যে কোভিড সংকটের পরে মসুর ডাল, গম, রান্নার তেল এবং চিনির দাম গড়ে ১০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। স¤প্রতি মরিচের দাম বেড়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিকভাবে ৫০০ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে। ছয়টি চিনিকল বন্ধ করার পর, হাজার হাজার দক্ষ শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছে, চিনির বাজার সম্পূর্ণভাবে কিছু আমদানিকারকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং দাম বৃদ্ধি একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, চিনি আমদানিকারকরা অলিগোপলি (সীমিত প্রতিযোগিতার একটি অবস্থা) এবং ক্ষমতাসীন দলের খুব কাছাকাছি এর মধ্যে রয়েছে সিটি গ্রæপ, দেশবন্ধু গ্রæপ, মেঘনা গ্রæপ, এস আলম গ্রæপ, আব্দুল মোমেন গ্রæপ এবং টিকে গ্রæপ।
আমরা বিদ্যুৎ খাতে আরেকটি অলিগোপলিও (সীমিত প্রতিযোগিতার একটি অবস্থা) দেখতে পাচ্ছি যেটি শুধু ভালোভাবে পরিচালিত খারাপ চুক্তির কারণে বিপুল মুনাফা করেছে। বিশেষ করে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য নয়, অলস বসে থাকার জন্য। এই সেক্টরের অল্প সংখ্যক ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ২০১১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৯০০ বিলিয়ন টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর মধ্যে এই সময়ে মাত্র ১২টি গ্রæপ ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এই গ্রæপগুলোর মধ্যে রয়েছে: সামিট গ্রæপ, এগ্রিকো ইউকে, এরডা পাওয়ার মালয়েশিয়া, ইউনাইটেড গ্রæপ, বাংলাক্যাট, ওরিয়ন, হোসাফ, মোহাম্মদী, সিকদার, ম্যাক্স এবং কনফিডেন্স (সমকাল, ২৫ জুলাই, ২০২২)। বিদ্যুৎ খাতের নিষ্কাশনের অন্যান্য সুবিধাভোগীদের মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রæপ, এনটিপিসি, রিলায়েন্স এবং ভারতের আদানি গ্রæপ।
আইএমইডির আগেই মানুষ জানত : ২৫ মে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি শাখা, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, বিদ্যুৎ খাতের ওপর একটি প্রতিবেদন জমা দেয়, যা আশ্চর্যজনকভাবে এই সেক্টরে সমস্যা এবং নিষ্কাশনের কথা স্বীকার করে। জুলাইয়ের প্রথম দিকে যখন এই প্রতিবেদনটি প্রধান মিডিয়াতে প্রকাশ করা হয়, তখন কর্তৃপক্ষ তাড়াহুড়ো করে এটিকে সংশোধিত একটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করে, যা ‘বিদ্যুৎ খাতের সমস্যা, সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জের চারটি পৃষ্ঠা’ বাদ দিয়ে দেয়। এই বিভাগে ‘বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা এবং বিদ্যুৎ খাতের খেলোয়াড়দের ক্ষতিপূরণ আইন দ্বারা প্রদত্ত সুরক্ষা’ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণ আইনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় কুইক এনহ্যান্সমেন্ট অফ ইলেক্ট্রিসিটি অ্যান্ড এনার্জি সাপ্লাই অ্যাক্ট অফ ২০১০। ক্ষতিপূরণ আইনটি আইনের অধীনে সম্পাদিত কর্মকর্তা এবং ক্রিয়াকলাপকে সুরক্ষিত করে। মূল প্রতিবেদনটি সঠিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং চুক্তি, বিশেষ করে ক্ষমতা চার্জ প্রদানের মডেলকে ‘লুটপাটের মডেল’ হিসাবে অভিহিত করেছে এবং সঠিকভাবে ক্ষমতা চার্জ, ওভারহোলিং চার্জ, করমুক্ত আমদানি, উচ্চ বিদ্যুতের দাম, সহজ ব্যাংক ঋণ এবং সস্তা জ্বালানি সরবরাহের প্রতি নির্দেশ করেছে। ‘পুঁজি ও দুর্নীতি নিষ্কাশনের প্রধান উৎস’ হিসেবে। তারা আরও দেখিয়েছে যে কীভাবে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত ‘অযোগ্য সরবরাহকারীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, প্রধানত চীন এবং ভারত থেকে, ভুল এবং অযৌক্তিক বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বা চুক্তির মাধ্যমে।’ সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ‘বিদ্যুৎ বিনিয়োগকারীরা ১৪ বছরে ৯০,০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই মিথ্যার উপর ভিত্তি করে যে এটি ব্যক্তিগত বিদ্যুৎ বিনিয়োগকে আকর্ষণ করার জন্য একটি প্রণোদনা ছিল।’ (নিউ এজ, জুলাই ৮, ২০২৩)
এসব তথ্য নতুন নয় : তারা মিডিয়া এবং স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়েছে। আমিও বহু বছর ধরে এই বিষয়গুলো নিয়ে লিখছি এবং কাজ করছি। আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে যে, ২০১০ সালে এই ক্ষতিপূরণ আইন যখন পাস হয়েছিল, তখন আমরা খুব খারাপ জিনিসগুলোর গন্ধ পাচ্ছিলাম। তাই আমরা জাতীয় কমিটির কাছে এটা বাদ দেওয়ার দাবি জানাই। সরকার, পরিবর্তে, নতুন মিথ্যাচার দিয়ে বারবার আইনের সময়সীমা বাড়িয়েছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। আসলে, এই আইনটি এই সেক্টরে একের পর এক সমস্ত অন্যায় এবং বিপর্যয়কর চুক্তির ঢাল হয়ে উঠেছে, দ্রæত ভাড়া, কয়লা, পারমাণবিক এবং এলএনজির জন্য। এই সমস্ত পদক্ষেপ এবং চুক্তি দেশের ঋণ এবং সম্পদের নিষ্কাশন বৃদ্ধি করেছে, সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত উপক‚লীয় এলাকায় বিশাল ঝুঁকি ও বিপত্তি তৈরি করেছে, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে এবং গ্রাহকদের জন্য এর দাম বাড়িয়েছে। তা সত্তে¡ও এগুলো মানুষকে প্রয়োজনীয় আরাম দিতে পারেনি, বেশি অর্থ প্রদানের পরও তারা দীর্ঘক্ষণ লোডশেডিংয়ের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু অনেক ভালো বিকল্প আছে। আমরা ২০১৭ সালে একটি বিকল্প পরিকল্পনা অফার করেছি, যাতে কয়লা বা পারমাণবিক ব্যবহার না করে সবার জন্য সস্তা, আরও পরিবেশবান্ধব এবং আরও টেকসই বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু সরকার দেশি-বিদেশি কোম্পানিকে বড় ব্যবসা দেওয়ার ভুল পথের পক্ষ নেয়।
অলিগোপলির জন্য সরকারের আরও প্রণোদনা : মুদ্রাস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপের সময়ে, মানুষ প্রকৃতপক্ষে লোভ-স্ফীতি প্রত্যক্ষ করছে, যেমনটি ইকোনমিস্ট বলেছে, ক্ষমতাবানদের ক্রমবর্ধমান লোভ নির্দেশ করতে। বাংলাদেশে অলিগোপলির লোভ নজিরবিহীন পর্যায়ে উঠেছে, নদী, বন, খোলা জায়গা, তীর, সরকারি প্রতিষ্ঠান, মেগা প্রকল্প সবই তাদের লোভী হাতে চলে গেছে। জুন মাসে, সরকার এই গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য আরও সমর্থন বাড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ১৮ জুন পাস করা ‘আয়কর বিল ২০২৩’, ‘বিদেশ ভ্রমণকারী ব্যক্তিদের জন্য সম্পদ বিবরণী বাধ্যতামূলক জমা দেওয়ার বিধান বাতিল করেছে’। বিলটি দুর্নীতি দমন কমিশনকেও অকার্যকর করে তুলেছে কারণ এটিকে আদালতের আদেশ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তাধিন ব্যক্তিদের কর, আয়, সম্পদ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত ডেটা অ্যাক্সেস করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, সরকার ২১ জুন ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধনী) বিল ২০২৩ পাস করেছে যা ব্যাংক মালিক সমিতির পরামর্শ অনুসারে ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ নয় বছর থেকে ১২ বছর বাড়িয়েছে। সব আর্থিক কেলেঙ্কারির পর এই পদক্ষেপ ব্যাংক-লুটপাটকারী অলিগোপলির কাছে সবুজ সংকেত ছাড়া আর কিছুই নয়।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞা : ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতির উপর একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন যাতে বলা হয়, ‘… এই নীতির অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করতে সক্ষম হবে, যা এর জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুন্ন করছে। এর মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে’। তবে ক্ষমতাসীন অলিগোপলির সদস্যদের নতুন ভিসার প্রয়োজন নাও হতে পারে। কারণ তাদের অধিকাংশই , সব না হলে, এবং তাদের পরিবারের মার্কিন পাসপোর্ট বা অন্তত গ্রীন কার্ড আছে! এর আগে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের প্রাক্তন মহাপরিচালককে দেশে প্রবেশের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে এবং র্যাবের হাতে বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগের জন্য ব্যাটালিয়নের আরও পাঁচজন কর্মরত ও প্রাক্তন কর্মকর্তাকে অনুমোদন দেয়। এই অনুমোদন দৃশ্যত দেশে বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাÐ হ্রাস করেছে। যাইহোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বাংলাদেশ এবং অন্যত্র ব্যাটালিয়ন এবং অনুরূপ সংগঠন গঠন ও শক্তিশালী করার জন্য তার দায়িত্ব স্বীকার করেনি। হ্যাঁ, জনগণের মরিয়াভাবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার যেখানে তারা তাদের ভোট দিতে পারে।
আনু মুহম্মদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং ত্রৈমাসিক সাময়িকী সর্বজনকথার সম্পাদক। সূত্র: নিউ এজ। অনুবাদ: মিরাজুল মারুফ