দলান্ধ না হলে শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়বেই
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
এবার ‘কিউএস’ ওয়ার্ল্ড র্যাকিংয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়েছে (৬৯১-৭০০ এর মধ্যে)। সময়ের সঙ্গে সামনে এগিয়েছে এইটা একটা ভীষণ আনন্দের ব্যাপার। তবে কষ্টও আছে। ঠিক কি কারণে এগিয়েছে তা এখনো জানি না। আরেকটি সুসংবাদ হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এইবার কিউএস র্যাংকিংয়েও ভালো করেছে (৮৫১-৯০০ এর মধ্যে)। ৭৩ এর অধ্যাদেশ চালিত অন্য ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় কেন র্যাংকিংয়ে থাকে না? এর একটা সার্জারি করে এর কারণ বিশদভাবে জানা উচিত।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান খুব ভালো করেছে। যেমন আইআইটি বোম্বে, দিল্লি, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, আইআইটি খড়গপুর, কানপুর, মাদ্রাজ, গোয়াহাটির র্যাংকিং যথাক্রমে ১৪৯, ১৯৭, ২২৫, ২৭১, ২৭৮, ২৮৫, ৩৬৪,৩৬৯। তাছাড়া দিল্লি ও আন্না ইউনিভার্সিটির র্যাংকিং ৪০৭ এবং ৪২৭। মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটির র্যাংকিং হলো ৫২৬। র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো করেছে এমন ১৫টি প্রতিষ্ঠান আছে।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো করেছে পাকিস্তানের এমন ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কি শুনতে কেমন লাগছে? এর মধ্যে পাকিস্তানের জাতির পিতার নামে বিশ্ববিদ্যালয় ‘কায়েদ এ আজম’ এর র্যাংকিং হলো ৩১৫। আর আমাদের জাতির পিতার নামে অনেকগুলো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে দেখলাম গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বাংলাদেশের মধ্যেই তলানিতে। হবেইবা না কেন? সেখানে কেমন ভিসি, কেমন কোষাধক্ষ নিয়োগ দেয় একটু পরখ করলেই টের পাবেন। তার উপর এইবার এর বাজেট হলো ৮৬ কোটি টাকা। একটি বিশ্ববিদ্যালয়, তাও আবার জাতির পিতার নামে এবং জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী, এর বাজেট হলো ৮৬ কোটি টাকা। খুবই পীড়াদায়ক। অন্যদিকে পাকিস্তানের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্সএন্ড টেকনোলজি এর র্যাংকিং ৩৬৭। অন্যদিকে লাহোর ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানেজমেন্ট সাইন্স এর র্যাংকিং হলো ৫৪০। অর্থাৎ তাদের এত সমস্যা থাকা সত্বেও তারা তাদের লেখাপড়াটা ঠিক রেখেছে।
এখন ভারত ও পাকিস্তানের যেইসব বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে এবং ৫০০ এর মধ্যে তাদের একটা কমন গুন হলো তাদের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি। ইন ফ্যাক্ট ভারতের সেরা আইআইটি ও আইআইএসসির শিক্ষকদের ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি এবং এক বা একাধিক পোস্ট ডক অভিজ্ঞতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং-এ এগিয়ে যাওয়ার একটা সূত্র এখনই বলে দিতে পারি। আগামী ১ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয় যদি দেশি বিদেশি মোট ৫০টি পোস্ট-ডক নিয়োগ দেয় যার মধ্যে অন্তত ৩০ জন যদি বিদেশি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং আগাতে বাধ্য। এইটা করলে শক্তিশালী পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করা যাবে। ফলে বিদেশি পিএইচডি শিক্ষার্থীও পাওয়া যাবে। তাহলে র্যাংকিংএ আরো ভালো করবে। এইসবই ইউনিভার্সিটি হওয়ার ইউনিভার্সাল রুল।
কায়েদ এ আজম বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক পদের জন্য এইমাত্র একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। পোস্ট-ডকের মাসিক বেতন কত জানেন? ১ লক্ষ ২০ পাকিস্তানী রুপি। একটু আগে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক নিয়োগের বিজ্ঞাপনও দেখলাম। সেখানকার বেতন হলো ৬৮ হাজার ভারতীয় রুপি। এতে কি প্রমাণিত হয়? আমাদের র্যাংকিং ভালো করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা হওয়া উচিত পিএইচডি। পোস্ট-ডক পজিশনের বেতন নিশ্চই সহকারী অধ্যাপকের কম দেওয়া যাবে না। এমনকি ৬৮ হাজার ভারতীয় রুপির বেশি না দিলে বিদেশী পোস্ট-ডকও পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন না বাড়ালে আন্তর্জাতিক মানের কম্পিটিটিভ শিক্ষক ও পোস্ট-ডক পাওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন অবশ্যই বাড়াতে হবে। যেই চাকরির ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি সেই চাকুরীর বেতন কীভাবে অন্যসব চাকরির মত হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ভালো মানের হলে ভালো মানের শিক্ষক পাবেন। ভালো মানের শিক্ষকদের আত্মসম্মানবোধ টনটনে থাকবে। তারা দলান্ধ হবে না। আর দলান্ধ না হলে শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়বেই। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়