দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের একটি কৃষি মূল্য কমিশন দরকার
ফিরদৌসী নাহের
‘শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে’ সংবাদপত্রের এই শিরোনামটি গত মাসে আমার নজর কেড়েছিলো এবং আমি হতাশার অনুভ‚তি নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনটি পড়ি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দ্বারা পরিচালিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস (বিএসভিএস) ২০২২ থেকে তথ্যটি এসেছে। প্রতিবেদনটি পড়ার পর প্রথম যে প্রশ্নটি আমার মাথায় এসেছিলো তা হলো ১৯৭০ সাল থেকে দেশে শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে আমরা কি অভ‚তপূর্ব অগ্রগতির সম্মুখীন হচ্ছি? প্রতিবেদনটি দেখায় যে ২০২১ সাল থেকে শিশুমৃত্যুর বিভিন্ন সূচকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে, পাঁচ বছরের কম বয়সী মৃত্যুর হার প্রায় ১১ শতাংশ বেড়েছে যখন নবজাতক-পরবর্তী মৃত্যুর হার (এক মাসের মধ্যে মৃত্যুহার এবং এক মাসের কম সময়ের মধ্যে) বয়সের বছর) ১৩ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণগুলো হল অসুস্থতা (যেমন নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, ইত্যাদি), অপুষ্টি এবং ডুবে যাওয়া।
নতুন বাজেট কেন আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে না : এই ফলাফলগুলো মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাবের সাথে অনেক বেশি সম্পর্কযুক্ত তা ভালভাবে বোঝা যায়। তবে আসুন আরেকটি কারণের উপর ফোকাস করা যাক – যেটি অপুষ্টির সাথে সম্পর্কিত। আমরা প্রাথমিকভাবে কি খাই তা নির্ভর করে আমাদের সামর্থ্যের উপর। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও খাদ্য ও অখাদ্য উভয় পণ্যের দাম বেড়েছে। বিবিএস-গণনাকৃত খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঋণ২৩-এর শেষ মাসে ৯.৭৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ বছরের সর্বোচ্চ, ৯.০২ শতাংশে। মে মাসে, সাধারণ মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্কের (৯.৯৪ শতাংশ) কাছাকাছি ছিল। শুধু গরীবরাই নয়, সমাজের সবাই এখন মূল্যবৃদ্ধির চাপ অনুভব করছে। এই ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধির কারণটি মূলত মহামারী দ্বারা সৃষ্ট সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরও ক্রমবর্ধমান হওয়ার জন্য দায়ী করা হয়েছে। এই বছরের শুরুতে যেমন দেখা গেছে, বিশ্ব ও আঞ্চলিক দাম কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সীমাবদ্ধতার কারণে দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি যা ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির দিকে পরিচালিত করেছে তা একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে প্রাক-মহামারী পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে বাংলাদেশে খাদ্যের দাম এক দশকেরও বেশি সময় ধরে খাদ্যবহির্ভূত দামের তুলনায় দ্রæত বাড়ছে। বিশেষ করে পুষ্টি-ঘন খাবারের দাম শক্তি-ঘন খাবারের, প্রাথমিকভাবে ভাতের তুলনায় অনেক দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯ সালের বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রধান খাদ্যের তুলনায় ডাল, মাংস, মাছ, ডিম, দুধ, ফল এবং সবজির মতো পুষ্টিকর খাবারের দাম ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি ছিল। একটি পুষ্টিকর খাদ্যের উচ্চ খরচ দেওয়া খুব কষ্টসাধ্য, তারা মানসম্পন্ন খাবার থেকে বঞ্চিত থাকে। এই ধরনের খাদ্যের অভাব শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। আমাদের মানব পুঁজি উন্নয়নের উপর এর পরিণতি নির্ভর করে।
মূল্য কমিশন গঠনের পরামর্শ নতুন নয়। অতীতে আমরা নীতিনির্ধারকসহ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একটি স্বাধীন মূল্য কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা শুনেছি। মূল্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রয়োজনীয়তা এখনকার চেয়ে এত তীব্রভাবে অনুভ‚ত হয়নি। এই ধরনের মহড়ার ব্যাপকতা ভালভাবে বোঝা যায় এবং কেউ আশা করতে পারে যে সরকার সফলভাবে এই প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারে। ঋণ২০২৩-২৪ বাজেট হলো সরকার যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয় তা মোকাবেলা করার জন্য সরকারের পছন্দের নীতির একটি সুনির্দিষ্ট প্রকাশ। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু খাতে উচ্চাভিলাষী হলেও, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বর্ধিত সহায়তা, নি¤œ-আয়ের গোষ্ঠীর মধ্যে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য বিতরণ এবং ভর্তুকি ব্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধি ছাড়াও বাজেট খাদ্য মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় খুব কমই জড়িত বলে মনে হয়। এই ব্যবস্থাগুলো হলো অস্থায়ী ত্রাণ প্রচেষ্টা, যার মধ্যে কিছু প্রায়শই প্রাপকদের উপর যথেষ্ট সময় এবং শক্তি খরচ করে। একটি সংস্থা যা বর্তমানে প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তা হলো বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে মূল্য পর্যবেক্ষণ এবং পূর্বাভাস সেল। কৃষি বিপণন বিভাগ এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা অধিদপ্তরের মতো আরও কয়েকটি সংস্থারও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দায়িত্ব হিসাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এমনকি আমাদের একটি প্রতিযোগিতা কমিশন আছে। কিন্তু যেমনটি স্পষ্ট, এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াগুলো এখনও তাদের ম্যান্ডেট মেনে চলতে পারেনি।
অস্থায়ী ত্রাণ ব্যবস্থা অবশ্যই অর্থপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগগুলোর দ্বারা সমর্থন করা উচিত যা অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্য হিসাবহীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। হিসাবহীন, কারণ আমরা অনেক প্রতিবেদনের গোপনীয়তা রয়েছি যেগুলো মূল্য বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করে যেগুলোর খরচের ধাক্কা মূল্যস্ফীতির বাইরে। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্টেলাইজেশন, “গ্রেডফ্লেশন” (মূল্য বৃদ্ধি উচ্চ মুনাফা মার্জিন দ্বারা নির্ধারিত) এবং বিদ্যমান নিয়ম ও প্রবিধানের প্রয়োগের অভাব। ২০২২ সালের মে থেকে ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২৯ শতাংশ পতন নিবন্ধন করেছে, তবে স্থানীয় বাজারে পতনটি ১০ শতাংশেরও কম ছিল। ৪৫ দিনে ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে, যখন উৎপাদন খরচে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। বিশ্ববাজারে পেঁয়াজের দাম ২৫ শতাংশ কমে গেলেও সরবরাহ ঘাটতির অজুহাতে বাংলাদেশে বাড়তে থাকে। জুনের শুরুতে সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিলে পরদিন স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম ১০-১৫ টাকা কমে যায়। মজার ব্যাপার হলো বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, দেশীয় পেঁয়াজের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। যদিও আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো সম্পর্কে আমরা কিছু করতে পারি না, তবে দাম বৃদ্ধির কারণ স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন কারণগুলো পরীক্ষা করার জন্য আমরা অনেক কিছু করতে পারি। এর জন্য একটি অর্থবহ পদক্ষেপ হতে পারে একটি কৃষি মূল্য কমিশন গঠন করা। এই ধরনের একটি সংস্থা, একটি স্থিতিশীল মূল্য পরিবেশ বজায় রাখার গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকার মাধ্যমে, উৎপাদক, ভোক্তা এবং সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থের দিকে নজর দেবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে, ২৩টি কৃষি পণ্যের জন্য একটি লাভজনক এবং স্থিতিশীল মূল্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে ১৯৬৫ সাল থেকে কৃষি খরচ ও মূল্য কমিশন কাজ করছে।
সাধারণ মানুষের হতাশার কারণ : প্রকৃতির অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে, কৃষি খাত সহজাতভাবে অস্থির, উৎপাদনের পরিমাণের কোনো নিশ্চয়তা নেই, এমনকি সেরা উপলব্ধ প্রযুক্তি গ্রহণের পরেও। যখন দাম বেড়ে যায়, তখন দুঃখজনক এবং অন্যায্য দিকটি হল যে কৃষকরা যারা খাদ্য উৎপাদন করে তারা অসহায় ভোক্তাদের কাছ থেকে সরাসরি মুনাফা নিতে পারেনা, প্রায়শই মধ্যস্বত্বভোগীদের কৌশলের কাছে হার মানতে হয় তাদেও, দুর্বল কৃষকদের এর চেয়ে হতাশাজনক আর কি হতে পাওে, শুধুমাত্র জীবিকা নির্বাহের জন্য উৎপাদন করতে বাধ্য হয় তারা বারবার। জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বব্যাপী বাহ্যিক হুমকির সাথে মিলিত এই ধরনের একটি কৃত্রিমভাবে প্ররোচিত ঘটনা আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির জন্য ধ্বংসাত্মক হবে। একটি স্বাধীন কৃষি মূল্য কমিশন, যাকে তার আদেশের অধীনে সমস্ত পণ্যের জন্য কার্যকর মূল্য সুপারিশ করার দায়িত্ব অর্পিত করা হয়েছে, এমন একটি বিষয় যা সরকারকে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। এই প্রযুক্তিগত সংস্থাটি প্রযোজক এবং ভোক্তা উভয়ের উপর ফলাফলের কথা মাথায় রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে একটি বিস্তৃত বিষয় বিবেচনা করে তার সুপারিশগুলো প্রদানের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে সক্ষম হবে।
মূল্য কমিশন গঠনের পরামর্শ নতুন নয়। অতীতে আমরা নীতিনির্ধারকসহ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একটি স্বাধীন মূল্য কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা শুনেছি। মূল্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রয়োজনীয়তা এখনকার চেয়ে এত তীব্রভাবে অনুভ‚ত হয়নি। এই ধরনের মহড়ার ব্যাপকতা ভালভাবে বোঝা যায় এবং কেউ আশা করতে পারে যে সরকার সফলভাবে এই প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারে। এটা মনে রাখতে সাহায্য করবে যে এলডিসি স্বাধিনতার ৫২ বছরে বহুলাংশে কৃষিপ্রধান দেশটির জন্য একটি কৃষি মূল্য কমিশন গঠন অপরিহার্য। সা¤প্রতিক বাজেটে এ বিষয়টি স্পর্শ না করলেও এর জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ব্যাপক কাজ এখনই শুরু করতে হবে।
ফিরদৌসী নাহের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। সূত্র: ডেইলি স্টার। অনুবাদ:মিরাজুল মারুফ।