জেলাগুলো কি পিছিয়ে পড়ছে, যখন বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন করছে
ড. সৈয়দ আবুল বাশের এবং
ড. ফ্রান্সেসকা ডি লরিও
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে চিত্তাকর্ষক লাভ সত্তে¡ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পৃথক অঞ্চলগুলো সামগ্রিকভাবে দেশের মতো ভালো নয়। বিস্তারিত জানার আগে, আমাদের কিছু পটভ‚মি প্রদান করার অনুমতি দিন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর, বাংলাদেশ দুটি স্বতন্ত্র উপায়ে অন্যান্য অনেক উন্নয়নশীল দেশকে ছাড়িয়ে যায়। প্রথমত, একটি উল্লেখযোগ্য স্বল্প সময়ের মধ্যে, প্রজনন হার ১৯৭১ সালে ৬.৯ থেকে ২০০১ সালে ৩.১-এ নেমে আসে। অন্য কথায়, একটি একক প্রজন্মের মধ্যে, বাংলাদেশ তার প্রজনন হারকে অর্ধেক করতে সক্ষম হয়েছিল, এটি একটি কৃতিত্ব যা ইংরেজিভাষী এবং উত্তর-পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে ১০০ বছরে। আমরা এনজিও, দাতা দেশ এবং সরকারের প্রচেষ্টার জন্য এই চিত্তাকর্ষক সাফল্যের জন্য ঋণী, যা একটি সীমাবদ্ধ আর্থিক পরিবেশের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তুলনামূলক হ্রাসের হার প্রদর্শনকারী একমাত্র অন্য দেশটি ছিল জাপান, তবে এটি অবশ্যই উল্লেখ্য যে জাপান যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে আর্থিক এবং গঠনতন্ত্রে ভালো অবস্থার মধ্যে ছিল।
দ্বিতীয়ত স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কম হওয়া সত্তে¡ও এটি ১৯৮০ সাল থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যাগত কারণ এবং লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে আরও ভালো সামাজিক উন্নয়ন ফলাফল অর্জন করেছে। প্রতিটি উন্নয়ন সূচকে ভারত ও পাকিস্তান। উন্নয়ন সাহিত্য উচ্চতর সামাজিক উন্নয়ন এবং নি¤œ আয়ের স্তরের এই অপ্রত্যাশিত সংমিশ্রণকে ‘বাংলাদেশ ধাঁধা’ বা ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে অভিহিত করেছে। স¤প্রতি আমাদের মধ্যে একজন আমাদের শিক্ষার্থীদের আরও সা¤প্রতিক ডেটা সহ এই বিকাশের বিবরণ আপডেট করতে বলেছে। আমরা দেখেছি যে ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে বেশি এবং বাংলাদেশ এখনও বেশির ভাগ উন্নয়ন সূচকে ভারত ও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাড়ছে বৈষম্য, আর উন্নয়নের ঢাক : বৈষম্যের উত্থান, উন্নয়নের ঢোল তাই কোনো সন্দেহ নেই যে স্বাধীনতা-পরবর্তী অনেক অনন্য চ্যালেঞ্জ সত্তে¡ও সামগ্রিকভাবে দেশটি স্বল্প সময়ের মধ্যে উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। যাইহোক সামগ্রিক অগ্রগতি উন্নয়নের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ গোপন করতে পারে। এইভাবে একটি প্রশ্ন জাগে: উন্নয়ন ফলাফলের লাভ কি দেশের সব অঞ্চলে সমানভাবে বিতরণ করা হয়েছে? প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আর্থার লুইস বিখ্যাতভাবে বলেছিলেন যে ‘উন্নয়ন অবশ্যই বৈষম্যহীন হতে হবে কারণ এটি একই সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি অংশে শুরু হয় না।’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কি তাই হয়েছে?
একটি নতুন গবেষণা পত্রে, আমরা ২০০০ এবং ২০১৬-১৭ বছরের মাথাপিছু আয়ের ডেটা ব্যবহার করে ৬৪টি জেলার জন্য এই প্রশ্নটি মোকাবেলা করেছি। যেহেতু জেলা-পর্যায়ের আয়ের তথ্য বাংলাদেশে প্রকাশিত হয় না, তাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দ্বারা প্রকাশিত পারিবারিক আয় এবং ব্যয় জরিপ থেকে আয়ের তথ্য তৈরি করে আমরা এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করি। পারিবারিক আয় থেকে জেলা-স্তরের আয়ের পরিমাপ করা সহজ নয় এবং অর্থনীতিতে প্রচুর যতœ প্রয়োগ করতে হবে।
২০২২: যে বছর ধনীরা জিতেছে এবং জনসাধারণ হেরেছে : আমরা যে ফলাফলগুলো পেয়েছি তা ভাগ করার আগে আয় অভিসারের ধারণাটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। কনভারজেন্স একটি গাণিতিক সম্পত্তি, কিন্তু এটি দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে আয়ের ব্যবধান একত্রিত হচ্ছে (সঙ্কুচিত হচ্ছে) বা সময়ের সাথে বিবর্তিত হচ্ছে (প্রশস্ত হচ্ছে) তা বোঝাতে অর্থনীতিতে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের ফলাফলগুলো প্রকাশ করে যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিওক্লাসিক্যাল মডেলগুলোর দ্বারা পূর্বাভাসের বিপরীতে, দরিদ্র জেলাগুলো ধনী জেলাগুলোর সাথে তাদের আয়ের ব্যবধান দূর করার জন্য যথেষ্ট দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কনভারজেন্সের গতি অত্যন্ত ধীর, মাত্র ০.৪ শতাংশ, যা প্রস্তাব করে যে বাংলাদেশের দরিদ্র ও ধনী জেলার মধ্যে আয়ের ব্যবধানের অর্ধেক দূর করতে প্রায় ১৭০ বছর সময় লাগবে। এই ফলাফলটি হতাশাজনক, কারণ কেউ আশা করবে যে দরিদ্র অঞ্চলগুলো তাদের ধনী সমকক্ষদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য যথেষ্ট দ্রæত বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে আয়ের কোনো মিল না পাওয়া আশ্চর্যজনক, কারণ দেশের উন্নয়নের একটি অনন্য দিক ট্রিকল-ডাউন প্রভাবের উপর নির্ভর না করে নীচের দিকে বা বিস্তৃত-ভিত্তিক উন্নয়নের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছিল।
ভৌগোলিক নৈকট্য অগত্যা বাংলাদেশের দরিদ্র ও ধনী জেলার মধ্যে আয়ের একীকরণ সহজতর করে না। এই বিস্ময়কর আবিষ্কারকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে মাত্র দুটি জেলায় অর্থনৈতিক কর্মকাÐের ঘনত্বের আলোকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম। উপযুক্ত অর্থনৈতিক অবস্থা, নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপস্থিতি ব্যতীত, ভৌগোলিক নৈকট্যের সুবিধাগুলো বাংলাদেশের সমস্ত জেলাজুড়ে সমানভাবে উপলব্ধি করা যায় না। ঢাকার মতো একটি জেলার সাথে আয়ের ব্যবধান দূর করার জন্য গাইবান্ধার মতো একটি দরিদ্র জেলার জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের, আমরা দরিদ্র মধ্যম আয়ের এবং ধনী জেলাগুলো নিজেদের মধ্যে একত্রিত হচ্ছে কিনা তাও পরীক্ষা করেছি। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সাহিত্যে এই ধারণাটি ‘ক্লাব কনভারজেন্স’ নামে পরিচিত। ফলাফল অত্যন্ত হতাশাজনক ছিল, এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আয়ের স্তরের মধ্যেও আয়ের অভিন্নতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আমরা সারা দেশে বিভিন্ন আয় গোষ্ঠীর মধ্যে আয়ের অভিন্নতা নির্ধারণের জন্য দুটি মেশিন-লার্নিং রুটিনও নিযুক্ত করেছি। যাইহোক আমরা বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে আয়ের অভিন্নতার কোনো প্রমাণ খুঁজে পাইনি।
মধ্যম আয়ের ফাঁদ এড়াতে পারে বাংলাদেশ : বাংলাদেশে আয়ের কোনো মিলন না পাওয়া আশ্চর্যজনক, কারণ দেশের উন্নয়নের একটি অনন্য দিক ট্রিকল-ডাউন প্রভাবের উপর নির্ভর না করে নীচের দিকে বা বিস্তৃত-ভিত্তিক উন্নয়নের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছিল। যদিও আমাদের অধ্যয়ন আয় একত্রিত হওয়ার সম্ভাব্য বাধাগুলো তদন্ত করেনি, তবে একটি সম্ভাবনা হতে পারে যে পরিবারের আয়গুলো উল্লেখযোগ্য ত্রæটির সঙ্গে পরিমাপ করা হয়, যা পরিণতিতে সনাক্তকরণের কাজকে জটিল করে তোলে। উপরন্তু এটা সম্ভব যে বাংলাদেশে আঞ্চলিক আয়ের গতিশীলতা ক্রমাগত আয়ের বৈষম্য এবং একাধিক স্থিতিশীল আয়ের স্তরের অস্তিত্ব দ্বারা চিহ্নিত করা হয়Ñ যে পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক পরিভাষায় ‘মাল্টিপল ভারসাম্য’ বলা হয়। যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে ক্রমাগত আয় বৈষম্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। উন্নয়ন লাভ এবং আয়ের ভিন্নতার মধ্যে অনুপস্থিত লিঙ্ক বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
বেকারত্ব সম্পর্কিত সরকারি তথ্য কতটা নির্ভরযোগ্য? : আয়ের শর্তসাপেক্ষ দ্ব্যর্থহীন প্রত্যাখ্যান আর্থার লুইসের ধারণাকে শক্তিশালী করে যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে অসম ছিল। নীতিগত প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ফলাফলগুলো পরামর্শ দেয় যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের মুখে দেশের আরও দরিদ্র অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য বড় আকারের নীতি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে। তদুপরি ক্ষুদ্রঋণের মতো ছোট-বড় হস্তক্ষেপ ক্রমাগত বৈষম্যের চূড়ান্ত সমাধান নয়, সা¤প্রতিক গবেষণা জোর দেয় যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে কার্যকর পথ শিক্ষাই রয়েছে। কনফুসিয়াসকে ব্যাখ্যা করার জন্য, ১০ বছরের সুবিধার জন্য, আমাদের অবশ্যই আমাদের সামাজিক সমর্থনকে শক্তিশালী করতে হবে এবং একশো বছরের সুবিধার জন্য, আমাদের অবশ্যই শিশুদের শিক্ষিত করতে হবে।
ড. সৈয়দ আবুল বাশের ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি (ইডবিøউইউ), বাংলাদেশের অর্থনীতির অধ্যাপক। এবং ড. ফ্রান্সেসকা ডি লরিও ইতালির নেপলস ফেডেরিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান এবং অর্থনীতির অধ্যাপক। সূত্র : ডেইলি স্টার। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ