আমাদের দু’জন চিকিৎস কারাগারে, তাদের অপরাধ কী
ইকবাল আনোয়ার
‘যেকোনো ওষুধে সামান্য থেকে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে’। এটা জেনেই চিকিৎসা নিতে ও দিতে হবে। ‘এটা আমার প্রেসক্রিপশন প্যাডে লেখা আছে। লিখেছি বড় দুঃখে। জীবনের আর ক’টা দিন যদি বাঁচি, যদি রথে কুলায় তবে তো এ পেশাতেই থাকতে হবে। না এখনকার লেখাটায় জনসেবা, মানবসেবা এ দিকগুলো মনের ভিতরে চাপা রেখেই কথা ক’টি বলছি। লিখেছি বড় দুঃখে। সেই বিরাশি-তিরাশি থেকে চিকিৎসা পেশা-ই তো করে খাচ্ছি। আখাউড়া চাকরি করার সময় নানা রকম হুমকি, রোগীকে ভুল চিকিৎসা দিয়েছি, রোগী ভালো ছিলো, নাকে নল দিয়ে/ইনজেকশন দিয়ে/বুকে চাপ দিয়ে মেরে ফেলেছি এসব শুনতে শুনতে মনটা বিষিয়ে গিয়েছিলো। হয়রানির চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে। ঢাকার পথে পথে ঘুরে অন্য চাকরি তখন খুঁজেছি। নিদেনপক্ষে বেসরকারি প্রিভেনটিভ সাইডে চাকরি। আইসিসিডিআরবিতে চাকরি খুঁজতে গেছি। মনে হয়েছিলো এখানে চাকরি হলে জীবন ধন্য হতো।
আমি জানি, আজও আল্লাহ হেফাজত করুন, যদি কোনো শিশু, আমার প্রেসক্রিপশনে কোনো ওষুধ খেয়ে, আল্লাহ না করুন, মারা যায়, ‘তবে তো চিকিৎসকের ভুল ওষুধে রোগীর মৃত্যু হয়েছে’ এ অপবাদও এ জন্য কেইস হলে হাতকড়া পড়তে হবে। যেকোনো একটা বড়ি, কোনো ইনজেকশন নয়, যা হাজার হাজার মানুষকে দেওয়া হয়, নিরাপদ বটে, তা কোনো বিশেষ একজনকে দিলে, তার জীবন বিপন্ন হতে পারে, মৃত্যু হতে পারে। এটা হয় দুই ভাবে, [১] ডোজ রিলেটেড। [২] ইডিওসিক্রেটিক। এখানে ডোজ ফেক্টর নয়। এখন কথা যুক্তির কথায় আসি। একজন চিকিৎসক, মৃত্যু ঘটানোর জন্য যোগসাদশে এ ওষুধ দিলে, তা প্রমাণ করা গেলে, তবে অবশ্যই তিনি হত্যাপরাধে দায়ী হবেন। কিন্তু যদি, সকল বিবেচনায়, ‘অন গুড ফেইথ, রোগীর উপকারের জন্য এ ওষুধ দেন, তবে তো তাকে, ‘ভুল চিকিৎসা’ বলা যাবে না, হত্যা তো নয়ই।
এ বিষয়টিকে নির্ণয় করবেন? বিচারক। সেই মান্যবর বিচারক বা প্যানেলকে সেভাবে দক্ষ হতে হবে। বিদেশে রয়েছে এমন প্যানেল, এমন ব্যবস্থা, এমন আইন, এমন সাংবাদিক, এমন বিশেষ প্রচার মাধ্যম। কোনো কোনো দেশে হাসপাতালে প্রতিটি মৃত্যুর অডিট হয়। কেননা জীবন মূল্যবান। এ অডিটে বের করা হয়, কী কারণে মৃত্যটি হলো, অন্যথা হতে পারতো কি না, রোগীর চিকিৎসায় কোনো গাফিলতি করা হয়েছে কি না, ইত্যাদি। প্রতিটি রোগীর চিকিৎসায় চিকিৎসক এভাবে বিপদ জোনে থাকেন। প্রতিটি অপারেশন, ছোট বা বড়, প্রতিটি ডেলিভারী এক একটি মৃত্যু ঝুঁকি। চিকিৎসকে তাই বিএমডিসির রেজিষ্ট্রেশন নিতে হয়। যার তার কাছে তো এ ঝুঁকির কাজ করতে দেওয়া যায় না। জীবন নিয়ে কথা এটি। তবে দেখা যায় এ দেশে রেজিস্ট্রেশন নেই, এমন চিকিৎসকই বেশি, ফার্মেসিস্ট বাদ দিলাম, ওষুধের দেকানদারও চিকিৎসক। তারা হয়তো সরল মনে এসব করেন, তবে তা ভোগ করতে হয় রোগীকে, শিশু হলেতো কথাই নেই। আমি প্রতিদিন এসব অনাচার দেখি, দুধের শিশুও রেহাই পায় না।
মৃত্য হলেই হাসাপাতাল ভাঙচুর, চিকিৎসককে, স্বাস্থ্য কর্মীকে মারধর, অপমান, এমনকি হত্যা, এ দেশে হচ্ছে। এ সব ঘটনা, যতোটা না রোগীর স্বজন ঘটান, তার চেয়ে বেশি ঘটান, চাঁদা লোভী একধরনের মাস্তান। এখানে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার জন্য কোনো আইন নেই। ফলে সমাজ দিনে দিনে যেভাবে অসহিষ্ণু হচ্ছে, তাতে আগামী দিনে চিকিৎসকদের পক্ষে মন দিয়ে, রোগীর ভালোর জন্য ‘অন গুড ফেইথ’ কিছু করা যাবে না। মুমূর্ষ রোগী দেখলেই সবাই মানবতার কথা বাদ দিয়ে হাতকড়ার ভয়ে ডি-সোল্ডারিং করতে চাইবে। এতে ক্রুড ভাবে বলতে গেলে আখেরে বিপদ হবে রোগীর। এবং তাকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে, দেশ থেকে বিদেশে যেতে হবে। হয়তো যারা ধনী তাদের তেমন কোনো অসুবিধা হবে না, বা কম হবে। এ লেখায় এতক্ষণ কিন্তু রোগী পক্ষের কোনো কথা লেখা হয়নি। কেননা চিকিৎসকদের পক্ষ নিয়ে, এ উদ্দেশে এ লেখা সাজানো। তবু তা সংক্ষেপে বলি।
দেশে রোগী হয়রানি হচ্ছে। দালালি ব্যবসা হচ্ছে, অসহায় রোগী চিকিৎসা পাচ্ছে না, এসব কথা এক পাহাড় সমান। আমি যেহেতু চিকিৎসক, আবার রোগীও, আমি তাই দুই দিকের অভিজ্ঞতা রাখি। সে নিরিখে বলছি, রোগীদের যেন হয়রানি না হয়, সেজন্যও চাই রোগীবান্ধব নীতি। কারণ আমাদের সকল ব্যবস্থা হলো মানুষের জন্য। চিকিৎসকদের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য চিকিৎসক। তবে চিকিৎসকদের অনিরাপদ রেখে তা সম্ভব নয়। করোনাকালে এ দেশোর চিকিৎসক প্রমাণ করেছেন সেবা কীভাবে দিতে হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসকগণ চিকিৎসা দিয়েছেন তখন, একক পেশা হিসাবে তারা শহীদ হয়েছেন সবচে বেশি। একদিনে এতো বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকা দানকে তারা সম্ভব করেছেন। বিশ্বের কোনো দেশ তা কল্পনাও করতে পারেন না। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখলে লেখাটা বড় হবে।
আমাদের দুই চিকিৎসকে কারাগারে রাখা হয়েছে। তারা কি অপরাধ করেছেন জানি না, আদালত বলতে পারবেন, তারা কি মানুষ হত্যা করেছেন, বা হত্যা কাজে সহায়তা করেছেন? এসব হতে পারে, তবে বলা যাবে বিচারের পর, তারা জামিন অযোগ্য অপরাধ করে থাকলে তো ঠিক আছে, যদি তারা জামিন পেলে পালিয়ে যান, এমন শঙ্কা থাকে, তবে তো জামিন না দেওয়া ঠিক আছে। আমি কেবল, এ পরিস্থিতিতে, দেশে রোগী-চিকিৎসক, সুস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বান্ধব একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, সুবিচার, সুআইন, সুসাংবাদিকতা সুপরিবেশের জন্য সামাজিক দায় থেকে এ লেখা লিখছি।
লেখক: চিকিৎসক