সুপার ফুড ডিমের উপকারিতা কী কী?
ডা. মনিরুজ্জামান
একটি বড় মুরগির বড় ডিমে প্রোটিন আছে ৬ গ্রাম, এসেনশিয়াল এমাইনো এসিড আছে ৯টি, কোলেস্টেরল আছে ১৮৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন আছে এ, ডি, ই, বি-২, বি-৫, বি-৬, বি-১২, মিনারেল আছে আয়রন, ফলিক এসিড, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, কপার, জিংক, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, সালফার ইত্যাদি। এতোকিছু থাকার কারণে বর্তমানের পৃষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, ডিম একটি সুপার ফুড।
ডিম সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে চোখকে রক্ষা করে। সূর্যের আলোতে আছে আল্ট্রা ভায়োলিন রশ্মি যা চোখের ক্ষতি করে এবং তা থেকে ডিম আমাদের রক্ষা করবে। ডিমে রয়েছে ল্যুটিন এবং জিয়াক্স্যানথিন নামের দুটি উপাদান, যা চোখের সুস্থতাকে বাড়াবে। ডিমের কুসুমে রয়েছে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী কোলিন, যা গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে সাহায্য করে। এছাড়াও আছে এন্টি-অক্সিডেন্ট, যা আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং সুস্থ থাকার জন্য ইমিউন সিস্টেম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাছাড়া ডিম উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে সাহায্য করে। বর্তমানে অন্যতম মহামারি হলো ক্যান্সার। ডিম ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ডিম খাওয়ার পরেও ৭০ শতাংশ মানুষের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বাড়ে না, কিন্তু ৩০ শতাংশ মানুষের কোলেস্টেরল বাড়ে অল্পমাত্রায়। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, আপনার যদি কোলেস্টেরল স্বাভাবিক থাকে এবং লাইফস্টাইল ডিজিজ না থাকে, তাহলে প্রতিদিন নিশ্চিন্তে কুসুমসহ ১টি করে ডিম খান। আর যদি ২টি ডিম খেতে চান, তাহলে দ্বিতীয় ডিমটির শুধু সাদা অংশ খান, কুসুমটি ফেলে দিন। তবে কোনোভাবেই ৪টি ডিম খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কারণ ১টি ডিমে থাকে ১৮৬ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল আর ৪টি ডিম খেলে শরীরে প্রবেশ করে ৭৪৪ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল। প্রতিদিন শরীরে এতো কোলেস্টেরলের কোনো প্রয়োজন নেই।
আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন, এফডিএ, হেল্থলাইন ডট কম এবং ইউসিএসএফ হেল্থ এদের রেফারেন্সে বিজ্ঞানীরা বলছেন শরীরে যদি কোনো রিস্ক ফেক্টর না থাকে তাহলে ৩০০ মিলিগ্রামের বেশি কোলেস্টেরল একদিনে খাওয়া উচিত নয়। আর যদি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস, কোলেস্টেরল থাকে তাহলে ২০০ মিলিগ্রামের বেশি কোলেস্টেরল একদিনে খাওয়া উচিত নয়। বিজ্ঞানীরা কিছু তথ্য দিয়েছেন অবাক করার মতো তারা বলছেন, প্রতিদিন আমাদের শরীরে যেই পরিমান কোলেস্টেরল প্রয়োজন তার পুরোটাই আমাদের শরীর তৈরি করতে পারে এবং তা তৈরি করে লিভার ও কিছু কোষ। এই মুহুর্তে আমাদের রক্তে যেটুকু কোলেস্টেরল আছে তার তিন-চতুর্থাংশ তৈরি করেছে আমাদের শরীর (লিভার ও কোষ)। হার্ভার্ট হেল্থ পাবলিশিংয়ের চিফ মেডিকেল এডিটর ডা. হুয়ার্ড ই. উয়াইন হার্ভার্ডের যতো গবেষনা হয়েছে তাকে সাম-আপ করে বলেছে ‘ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বাড়ায় মূলত সেটুরেটেড ফ্যাট। খাবারের ভেতর যে কোলেস্টেরল থাকে তা রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ায় না।’ এটি একটি নতুন অভিমত, একটি নতুন গবেষনালব্ধ ফলাফল। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১টি করে ডিম খাওয়া যাবে।
আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন বলছেন, অধিকাংশ মানুষ যারা সুস্থ আসেন তারা প্রতিদিন ১টি ডিম খেতে পারবেন, আর যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, ডায়াবেটিকস আছে বা হার্টের রোগ আছে তারাও সর্বোচ্চ ১টি ডিম খেতে পারবে, তবে যারা বয়স্ক ব্যক্তি তারা ২টি ডিম খেতে পারবে তবে তাদের কোলেস্টেরল লেভেল নর্মাল থাকতে হবে এবং ডাইট হতে হবে হেল্দি। অর্থ্যাৎ তাদের পরামর্শ হচ্ছে প্রতিদিন ১টি ডিম খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত। হার্ট ফাউন্ডেশন অস্ট্রেলিয়া বলছে, যদি এলডিএল কোলেস্টেরল বেশি থাকে তবে সপ্তাহে ৭টির বেশি ডিম খাবেন না অর্থ্যাৎ প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১টি। বাংলাদেশের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগে. (অব) ডা. আব্দুল মালিকের বয়স ৯৪ বছর এবং তিনি এখনো অফিশিয়ালি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেন এবং এখনো কাজ করেন। তিনি বলেছেন তিনি সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন পুরো কুসুম সহ ডিম খান এবং বাকি তিন থেকে চার দিন অর্ধেক কুসুম সহ ডিমের সাদা অংশ খান। নৃ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ হচ্ছে মূলত তৃণভোজী এবং কিছুটা মাংসাশী। এর স্বপক্ষে তারা দুটি প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন ১. পরিপাকতন্ত্রের গঠন, ২. দাঁতের গঠন।
পরিপকতন্ত্রের গঠন: হরিণ একটি তৃণভোজী প্রাণী তার পরিপাকতন্ত্রের দৈর্ঘ্য ২৮ ফুট। বাঘ মাংসাশী প্রানী এর পরিপাক তন্ত্র ৩ থেকে ৭ ফুট। মানুষের পরিপাকতন্ত্রের দৈর্ঘ্য গড়ে ৩০ ফুট এতেই বোঝা যায় মানুষ তৃণভোজী প্রাণী। দাঁতের গঠন: বিজ্ঞানীরা বলছেন আমাদের ৪টি দাঁত কুকুরের দাঁতের মতো এই ৪টি দাঁতকে বলা হয় ক্যানাইন টুথ আর বাকি ২৮টি দাঁত ছাগল, গরু বা হরিণের দাঁতের মতো অর্থ্যাৎ রেশিও দাঁড়ায় ২৮ঃ৪। অর্থ্যাৎ ৭ঃ১ মানে ৭ দিন শাক-সবজি খেলে ১ দিন মাছ-মাংস খেতে পারবে কিন্তু আমরা একে উল্টো করে দিয়েছি আমরা ১ দিন খাই শাক-সবাজ আর বাকি ৭ দিন খাই মাছ-মাংস। নৃ-বিজ্ঞানীরা বলছেন আমাদের গঠন প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের ডিম খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো পৃথিবীতে শতবর্ষী কিছু এলাকা আছে যে এলাকার মানুষ ১০০ বছর বাঁচে। এই এলাকাগুলাকে একত্রে বলা হয় ‘বøু জোনস’। এই জোনের মানুষের দীর্ঘদিন বাঁচার পেছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে শাক-সবজি। তারা ৯০ মতাংশের বেশি উদ্ভিজ্জ খাবার খান এবং ১০ শতাংশের কম প্রাণীজ খাবার খান।
ডিমের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ হলো দেশি মুরগির ডিম। কিন্তু এখন তা প্রায় দুষ্কর হয়ে পরেছে বলে ফার্মের অর্গানিক ডিম খেতে হবে। তাছাড়া কোয়েল পাখির ডিম খাওয়া যেতে পারে এটি নিরাপদ এই ডিম আকৃতিতে ছোট বলে প্রতিদিন তিন থেকে চারটি ডিম খেতে পারেন। আমরা বিজ্ঞানসম্মত, স্বাস্থ্যসম্মত, পুষ্টিবিজ্ঞানসম্মত এবং নৃ-বিজ্ঞানের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যাভাস গড়ে তুলবো প্রতিদিন একটি ডিম খাবো কুসুম সহ। তাহলে আমরা ধীরে ধীরে স্বাস্থময়, কর্মময় এবং দীর্ঘ জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো।
সূত্র: কোয়ান্টাম মেথড (ইউটিউব চ্যানেল)। শ্রæতিলিখন: জান্নাতুল ফেরদৌস