ব্রিকস, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমি এবং বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি
ড. আহমদ আল কবির
কয়েক বছর আগে ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) তৈরি হয়েছে। ব্রিকসে বিশে^র প্রায় ৪১ শতাংশ মানুষের বসবাস। জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলো থেকে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু ব্রিকসের দেশগুলো বেশির ভাগই উন্নয়নশীল দেশ। বিশ^ব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় ১৬ শতাংশ ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো থেকে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের নেতৃত্বে ব্রিকসের যাত্রা হয়েছিলো। যাত্রার পর থেকেই ব্রিকসে চীনের প্রভাব অনেক বেশি লক্ষ্যণীয়। তবে ব্রিকসভুক্ত অন্য দেশগুলোও গুরুত্বপূর্ণ, অথচ মুখ্য ভ‚মিকা পালন করে থাকে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়াও ব্রিকসে অনেক বেশি অ্যাক্টিভ হয়েছে। বিশে^র অন্যান্য অনেক দেশও ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য বেশ উদগ্রীব। কারণ আমেরিকার নেতৃত্বাধিন জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলো বিশ^ অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছিলো। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ব্রিকস গঠন হয়েছে। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেকেই আছে। এই দেশগুলো ছোট নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও ব্রিকসের দিকে অনেকটা ধাবিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ব্রিকসে ধাবিত হওয়ার কারণে ব্রিকসের পাল্লা ভারী হয়ে উঠছে।
ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, কীভাবে ডলারের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আন্তঃদেশীয় ট্রেডিং শুরু করতে পারে। একটা কারেন্সির মধ্যে না থেকে আন্তঃদেশীয় কারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন করা যায় কিনা, বোঝার চেষ্টা করছে। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও বিশ^ব্যাংকের মতো করে বিশ^ব্যাপী কাজ করার চিন্তাভাবনা করছে। এই ব্যাংক থেকে সদস্য দেশ ও বাংলাদেশের মতো দেশও আর্থিক সহায়তা নিতে পারবে। কিছু কিছু দেশ নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে আর্থিক বা ঋণ সহায়তা পাওয়াও শুরু করেছে। ব্রিকসকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য রাশিয়া এখন অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্রিকস জি-সেভেনের চেয়েও অধিক শক্তিশালী হবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ হওয়ার পর অর্থনৈতিক জোট ব্রিকস অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আগে এই জোটের প্রতি ইন্টারেস্ট কম্পারেটিভলি কম ছিলো বিশে^র বিভিন্ন দেশের। এখন অনেক বেশি ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে ব্রিকসের প্রতি। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোতে এখন বিশে^র সবচেয়ে লার্জেস্ট ইকোনোমি। কারণ বিশে^র ইমার্জিং ডেভেলপিং দেশগুলো ব্রিকসের সঙ্গে আছে। ১১টি ইমাজিং কান্ট্রির মধ্যে ৫টা ব্রিকসে আছে কোনো না কোনো ভাবে।
চীনের নেতৃত্বে ব্রিকস গঠিত হওয়ার কারণে এখন আর আমেরিকার একক আধিপত্য নেই, অথবা জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোর আধিপত্য এখন অনেক কমে গেছে। বিশ^্যাংক ও আইএমএফের যে দৌরাত্ম্য ছিলো এতোদিন বিশ^ব্যাপী, সেটার আধিপত্য কমে আসছে। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এখন সেই জায়গায় ভাগ বসাবে। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আধিপত্য বাড়বে দিনে দিনে। এতে বিশে^র জন্যই ভালো হয়েছে বলে মনে করি। কারণ দুই বিশ^শক্তি জোটের এই লড়াই একটা ভারসাম্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যা এতোদিন প্রায় একক আধিপত্য ছিলো আমেরিকার নেতৃত্বে জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোর। এই দুই শক্তির মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা হলে, এর সুফল ভোগ করবে পুরো বিশ^। আবার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বা হিংসাত্মক মনোভাব প্রকাশিত হতে থাকলে, বিশে^র জন্য বড় বিপদও ডেকে আনতে পারে।
চীনের নেতৃত্বাধীন ব্রিকস অনেক বেশি এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ ব্রিকসের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা অনেক বেশি, জি সেভেনভুক্ত দেশগুলোর তুলনায়। কনজামশনও হাই। এতে মার্কেট প্রটেনশিয়ালও অনেক বেশি হাই। ব্রিকস বøক এখনো টোটালি ইউনিফাইড নয়। তাদের মধ্যেও স্বার্থের টানাটানি, মতপ্রার্থক্য আছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুক্ত ব্রিকসকে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাহায্য করছে। আগে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এতো ইউনিটি ছিলো না, এখন যেটা বেড়ে গেছে। ব্রিকসকে ঘিরে অনেক ভারনারাবিলিটি আছে, আবার অনেক সম্ভাবনাও আছে। ব্রিকস শক্তিশালী হলে বিশ^ব্যাংকের একচ্ছত্র আধিপত্য ও বিশ^ব্যাপী বিভিন্ন দেশকে ডিকটেড করার যে প্রবণতা তাদের মধ্যে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
আমাদের দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের এখনকার পরিস্থিতি কী? এখানে বেশকিছু ভালো খবর আছে। আবারও কিছু খারাপ খবরও আছে। খারাপ খবর হচ্ছেÑইনফ্লুশনের দিকে কড়া নজর রাখতে হবে। ইনফ্লুশন অনেক অনিয়নন্ত্রিত। একদিকে টাকার মান কমছে, অপরদিকে বাজারে অস্থিতিরতা বিরাজ করছে। আমরা দেখেছি, প্রাইভেট সেক্টরে বিদেশ থেকে আসা ঋণ প্রবাহ কমেছে। এটা একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে এই মুহূর্তে।
আমরা আমাদের আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমিয়েছি। এতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিলো, এটা হয়তো বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে গেলে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নীচে চলে আসবে। কিন্তু আমাদের রিজার্ভ যাতে না কমে, এজন্য আমাদের উৎপাদন ধরে রাখতে হবে। এটা করতে হলে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রপ্তানিতে পজেটিভ ট্রেন্ড আছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সেও ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। আমদানি ব্যয় মেটানোর ব্যাপারটা আমাদের জন্য চাপ হিসেবে থাকবে।
নতুন বাজেটের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখবোÑআমাদের অনেক ভালো সংবাদই দিয়েছে। একদিকে আমরা সংকোচনমূলক বাজেট করেছি, অপরদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়ে আনা কিংবা আমাদের উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেসবও আমরা নিয়েছি। গরিব বা প্রান্তিক মানুষদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আমরা যে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বাড়ানো হয়েছে। এতে হতদরিদ্র মানুষ আর্থিকভাবে সাপোর্ট পাবে। এ বছর প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ মানুষকে আমরা আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে নিয়ে এসেছি। এটা একটা বিরাট পদক্ষেপ। আয়-বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্যও পদক্ষেপ আছে।
আমরা খুবই ভাগ্যবান যে, আমাদের বেরো ধানের ফলন বাম্পার হয়েছে। আউশ ও আমন ফসল আছে সামনে। আমাদের শ্রমবাজারে বড় ধরনের খারাপ কিছু হওয়ার শঙ্কা নেই। তবে শ্রমবাজারকেও আমাদের দক্ষতানির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে কর্মবান্ধব শিক্ষার মাধ্যমে। দক্ষজনশক্তি যদি আমরা বিদেশে পাঠাতে পারি, এতে রেমিটেন্সের প্রবাহও বাড়বে। রেমিটেন্স প্রবাহে ফ্ল্যাকচুয়েশন আছে, তবে ওভারঅল ট্রেন্ড ইজ পজেটিভ।
আমাদের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ আছে, সম্ভাবনাও অনেক আছে। চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়েই আমাদের চলতে হবে। এগোতে হবে। কাজ করতে হবে। প্রস্তুতি থাকতে হবে দীর্ঘমেয়াদীÑ যেন যেকোনো আকর্ষিক সংকট মোকাবেলা করতে পারি। স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থায় সংকট সমাধান আশা করা যায় না। দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, পলিসির কন্টিনিউশন থাকা খুবই প্রয়োজন।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আগে ইউরোপের ওপর অনেক বেশি নির্ভর ছিলো। এখন সেই পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে তারা এখন পণ্য কিনছেন। বাংলাদেশেরও অনেক পণ্য মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে এখনো যে আমরা খুব ভালো করছি, এটা বলতে চাই না। কিন্তু মাধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করার অনেক সুযোগ আছে আমাদের। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে যদি পণ্য নিয়ে আমরা প্রবেশ করতে পারি, রপ্তানি অনেক বেড়ে যাবে।
রপ্তানি বাজারে আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাচামাল ক্রয়। কারণ কাচামালের দাম অনেক বেড়েছে। সুতাসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের পণ্যের দামও বাড়ছে। এতে করে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কিছু সুবিধা কমছে। এটা কেবল আমাদের ক্ষেত্রেই বাস্তবতা নয়, অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই। তবে আমরা যদি পোশাকের র-মেটারিয়ালসগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি করতে পারি, তাহলে রপ্তানি বাজারে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারবো। আমাদের রপ্তানি প্রবণতা খুবই ভালো। গেøাবাল এনভায়রনমেন্টও আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বেশি সহায়ক।
পরিচিতি : সাবেক চেয়ারম্যান, রূপালি ব্যাংক