জলবায়ু পরিবর্তন, নেট-জিরো ট্রানজিশন এবং গ্রিন ফাইন্যান্স
মো. জহুরুল আল মামুন
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের ৬০টি বৃহত্তম ব্যাংক জীবাশ্ম জ্বালানি সংস্থাগুলোর জন্য ৪.৬ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করেছে। যা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনিতি জার্মানির মোট দেশজ উৎপাদনের চেয়ে বেশি। শুধু ২০২১ সালে তারা ৭৪২ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল অর্থ প্রদান করেছে। এই বিস্ময়কর পরিমাণ অর্থ কয়লা, তেল ও গ্যাস উৎপাদন ও ব্যবহার থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনকে সহযোগিতা দেয়। শীর্ষ চারটি মার্কিন ব্যাংক, জেপি মরগান চেজ,সিটিগ্রæপ,ব্যাংক অব আমেরিকা এবং ওযেলস ফারগো হল সবচেয়ে খারাপ, যা ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চিহ্নিত সমস্ত অর্থায়নের এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী। তারা সবচেয়ে দূষণকারী এবং কার্বন-নিবিড় জীবাশ্মকে সমর্থন করেছে। জ্বালানি কোম্পানি এবং প্রকল্প যেমন অতি-গভীর জলের তেল, গ্যাস নিষ্কাশন এবং আলকাতরা বালি। বড় ব্যাংকগুলো প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যকে উপেক্ষা করছে বা অবমূল্যায়ন করছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প স্তরের উপরে ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে সীমাবদ্ধ করার জন্য এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্রæত এবং গভীরভাবে হ্রাস করা প্রয়োজন। ২০৫০ সালের মধ্যে বা তার আগে নেট-শূন্য নির্গমনকে সমর্থন করার জন্য তাদের পাবলিক প্রতিশ্রæতি থাকা সত্তে¡ও তারা জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য বৃহৎ পরিসরে অর্থায়ন চালিয়ে প্যারিস চুক্তির নিতি ও লক্ষ্য লঙ্ঘন করছে।
ফসিল জ্বালানি অর্থায়ন বলতে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পে আর্থিক পরিষেবা এবং পণ্য সরবরাহ করা বোঝায়, যার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং বিভিন্ন কারণ দ্বারা প্রভাবিত। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির রিপোর্ট অনুযায়ী, জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থায়ন শিল্প বিপ্লবের সময়কার, যখন কয়লা শক্তির প্রধান উৎস ছিল। তারপর থেকে, জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থায়ন বিকশিত এবং বৈচিত্রময় হয়েছে, আর্থিক খাতে বিভিন্ন অভিনেতা এবং প্রতিষ্ঠান জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিনিয়োগ ব্যাংক, সম্পদ ব্যবস্থাপক, পেনশন তহবিল, বীমা কোম্পানি, উন্নয়ন ব্যাংক, রপ্তানি ঋণ সংস্থা, বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য। অধিকন্তু, জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থায়ন বিভিন্ন রূপ নিতে পারে, যেমন ঋণ, বন্ড, ইক্যুইটি ইস্যু, আন্ডাররাইটিং, সম্পদের মালিকানা, বীমা কভারেজ, গ্যারান্টি, পরামর্শমূলক পরিষেবা ইত্যাদি। জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থায়ন বাজারের প্রবণতা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, নিতি পরিবর্তন, সামাজিক আন্দোলন এবং জলবায়ু প্রভাব সহ অনেকগুলো কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। উল্লেখযোগ্যভাবে বিবেচনা করার জন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ এবং প্রবণতা রয়েছে । প্রথমত নবায়নযোগ্য শক্তির উৎেসর তুলনায় উচ্চ কার্বনের তীব্রতার কারণে কয়লা অর্থায়ন লাভজনকতা হ্রাসের সম্মুখীন হয়েছে । অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের পোর্টফোলিও থেকে কয়লা অর্থায়নকে সীমাবদ্ধ বা বাদ দিয়েছে। দ্বিতীয়ত উচ্চ কার্বন নিঃসরণ এবং পরিবেশগত প্রভাব থাকা সত্তে¡ও তেল ও গ্যাসের অর্থায়ন তার ক্রমাগত চাহিদা এবং লাভজনকতার কারণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখনও তাদের পোর্টফোলিও থেকে তেল এবং গ্যাস অর্থায়ন সীমিত বা বাদ দেওয়ার নিতি গ্রহণ করেনি। এই চ্যালেঞ্জগুলোর বিপরীতে সবুজ অর্থায়ন তহবিলের একটি বিকল্প রূপ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে যা নি¤œ-কার্বন এবং জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক উন্নয়নকে সমর্থন করে।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক আড়াআড়ি : রেইনফরেস্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক এবং অন্যান্য এনজিওগুলোর একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে বড় ব্যাংকগুলো ২০২০ সালে সবচেয়ে বড় স¤প্রসারণের পরিকল্পনা সহ সৌদি আরামকো, এক্সন মোবিল, কাতার পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাজপ্রম সহ ১০০টি জীবাশ্ম জ্বালানি সংস্থার জন্য তাদের অর্থায়ন বাড়িয়েছে। শীর্ষ চারটি মার্কিন ব্যাংক এখনও বিশ্বের বৃহত্তম জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের তহবিলকারীদের মধ্যে রয়েছে, যা ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৯৭৬ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের জন্য অ্যাকাউন্ট করে। ২০৫০ সালের মধ্যে নেট শূন্য নির্গমন অর্জনের প্রতিশ্রুতি সত্তে¡ও পাঁচটি প্রধান যুক্তরাজ্যের ব্যাংক – বার্কলেস, এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, লয়েডস এবং ন্যাটওয়েস্ট একই সময়ে জীবাশ্ম জ্বালানি সংস্থাগুলোকে নতুন তহবিলের জন্য একটি বিস্ময়কর ৩১২.৪৪ বিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে, ব্যাংকিং অন ক্লাইমেট ক্যাওস অনুসারে এনজিওগুলোর একটি জোট এই পরিমাণগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত করার প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যের সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১৪৫ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন সহ বার্কলেজ ইউকে ব্যাংকগুলোর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য বৃহত্তম অর্থায়ন প্রদানকারী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ জলবায়ু ফাইন্যান্স ক্যাম্পেইন গ্রæপ মার্কেট ফোর্সেসের ‘রেস টু ডিজাস্টার’ রিপোর্ট অনুসারে ব্যাংকটি এনব্রিজকে ১৯৪ মিলিয়ন ডলারের বন্ড প্রদান করেছে, একটি পাইপলাইন কোম্পানি যা ডাকোটা অ্যাক্সেস পাইপলাইনের সহ-মালিকও। পৃথিবীর সবচেয়ে দূষণকারী জ্বালানি হিসাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত টার স্যান্ডস তেলের কানাডিয়ান উৎপাদক এমইজি এনার্জিকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রস্তাব দিয়েছে।
এইচএসবিসি এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ২০২১ সালে নতুন জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে, উভয় ব্যাংকই বিশ্বের সবচেয়ে দূষণকারী কোম্পানি সৌদি আরামকোকে ৬ বিলিয়ন ডলারের বন্ড ইস্যুতে অংশগ্রহণ করেছে। এছাড়াও এইচএসবিসি বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্রের মালিক কাতার পেট্রোলিয়ামের জন্য ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বন্ডে অর্থায়ন করেছে যা ২০২৭ সালের মধ্যে তার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষমতা ৬৪ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। ২০২১ সালে লয়েডসই একমাত্র যুক্তরাজ্যের ব্যাংক যেটি তার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য তহবিল, জীবাশ্ম জ্বালানি সংস্থাগুলোতে ১.৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, এটি আগের বছরের তুলনায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ন্যাটওয়েস্ট জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য তার অর্থায়ন ৭৫ শতাংশ কমিয়েছে কিন্তু তারপরও ২০২১ সালে ১.২ বিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে। যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাটওয়েস্ট তার জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থায়ন কমাতে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি করেছে। এই তথ্যগুলো দেখায় যে মার্কিন এবং যুক্তরাজ্যের ব্যাঙ্কগুলো এখনও তাদের নেট-শূন্য প্রতিশ্রুতি এবং নিতি থাকা সত্তে¡ও জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য বৃহৎ পরিসরে অর্থায়ন করছে যা জলবায়ু এবং বিশ্ব অর্থনিতিকে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে। মার্কেট ফোর্সেস দেখেছে যে অস্ট্রেলিয়ার বড় চারটি ব্যাংক – এএনজেড,কমনওয়েলথ ব্যাংক,এনএবি এবং ওযেস্টপ্যাক ২০২০ সালে নোংরা কয়লা, তেল ও গ্যাস শিল্পে ৮.৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে যা ২০১৯ সাল থেকে ১৮ শতাংশ বেশি, ২০১৬ সাল থেকে ঋণ দেওয়ার মোট পরিমাণ ৪৪.৪ বিলিয়ন ডলার এ নিয়ে এসেছে। দ্য গার্ডিয়ানের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাংকগুলো নতুন জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে যা প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে ২১ বার জাতীয় নির্গমন হ্রাস লক্ষ্য বাতিল করবে।
যদিও কিছু ব্যাংক তাদের জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থায়ন কমিয়েছে এবং প্যারিস চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাদের পোর্টফোলিওগুলো আনার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে, তবে এই প্রবণতা বজায় থাকবে এবং বিপর্যয়কর গেøাবাল ওয়ার্মিং প্রতিরোধে যথেষ্ট হবে কিনা তা অনিশ্চিত। নেট-জিরো ট্রানজিশন এবং গ্রিন ফাইন্যান্সের প্রতি প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হওয়ার ব্যাংকগুলোর দাবি সত্তে¡ও, প্রতিবেদনের ফলাফলগুলো এই বিবৃতিগুলোর বিপরীত। জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত যে বাধ্যবাধকতা এবং প্রতিশ্রæতি দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যাপকতার সঙ্গে পূরণ করতে পারেনি।
মো. জহুরুল আল মামুন, একজন স্বাধীন জলবায়ু গবেষক। সূত্র : নিউএজ । অনুবাদ ও ইষৎ সম্পাদিত : মিরাজুল মারুফ